সমাজ
নারী তাহলে নিরাপদ কোথায়!

ড. সাদেকা হালিম
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১৩:২৭
সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে ধর্ষণের মতো ঘটনা আমাদের হতবাক না করে পারে না। গত সপ্তাহেই খাগড়াছড়িতে একজন প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম আরও ঘটনা ঘটেছে। সিলেটের ঘটনায় নানা প্রতিবাদ আমরা দেখছি। কিন্তু ধর্ষণ কোনোভাবেই থামছে না। ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার পেছনে মোটাদাগে চারটি বিষয় আমরা দেখছি- সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগত।
সামাজিকভাবে অনেকে মনে করে থাকেন, মেয়ের দ্রুত বিয়ে হয়ে গেলে বুঝি তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো। কিংবা পরিবারের খুব কাছাকাছি থাকলে মেয়ের ক্ষতি হবে না। বাস্তবে এগুলো নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণ বন্ধে রক্ষাকবচ হতে পারেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজে শিশু যেমন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তেমনি বয়স্করাও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সিলেটের ঘটনায় তরুণী ছিলেন বিবাহিত। শুক্রবার রাতে এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে নিজেদের গাড়িতে বসে স্বামী-স্ত্রী গল্প করছিলেন। সেখান থেকেই তরুণীকে পাঁচজন নিয়ে যায়। খাগড়াছড়িতে ডাকাতরা ঘরেই প্রতিবন্ধী মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। তাহলে নারী নিরাপদ কোথায়? অনেকে নিরাপত্তার কারণে মেয়েকে দূরে পড়তেও দিতে চায় না। নিজেদের কাছে রেখেও তো আমরা তাদের রক্ষা করতে পারছি না। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক নানা কুসংস্কারে নারী পরিবারে আবদ্ধ হয়ে থাকছে। ধর্ষণ সমাজে এতটাই সহজে ঘটছে যে, সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নারীর নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সর্বাগ্রে রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে এ ক্ষেত্রে তৎপর হতেই হবে।
সামাজিকভাবে নারীকে দেখার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার জন্য কম দায়ী নয়। পুরুষ যখন নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবে, নারীকে তার অধীন মনে করে। সমাজে নারীর অবদান-অর্জনকে অবমূল্যায়ন এবং পুরুষের অধস্তন পর্যায়ে দেখার ফলে সহিংসতা, নির্যাতন ও অমর্যাদা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে; নস্যাৎ করে দিচ্ছে মানবিক মর্যাদা, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের সোনালি স্বপ্ন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, নাগরিক সমাজের নানা উদ্যোগ ও সরকারের প্রচেষ্টা- এত রক্ষাকবচ, তবুও নারীর প্রতি অন্যায্য আচরণ ও সহিংসতা কোনোভাবেই কমছে না। এখনও দেশের বেশির ভাগ পুরুষ মনে করেন, নারীর গায়ে হাত তোলার অধিকার তারা রাখেন। এমনকি কয়েক বছর আগের গবেষণাতেই এটা দেখা গেছে। আইসিডিডিআর,বির বাংলাদেশে লিঙ্গীয় পরিচয় (জেন্ডার) এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে পুরুষের মনোভাব ও চর্চা শীর্ষক গবেষণা বলছে, গ্রামের ৮৯ ও শহরের ৮৩ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে গায়ে হাত তোলার অধিকার আছে স্বামীর। শহরের ৫০ ও গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত।
নারীর প্রতি সামাজিক এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মধ্যে আগে পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা দেখছি, কারিকুলামে কিছু পরিবর্তন এসেছে। কারিকুলাম পুরোপুরি জেন্ডারবান্ধব করে সাজিয়ে যথাযথ শিক্ষা দিতে পারলে নারীর প্রতি ইতিবাচক শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। যার ফল আমরা সমাজেও দেখব।
অর্থনৈতিকভাবেও নারীকে আমরা অবদমিত করে রাখতে চাইছি। শ্রমবাজারে নারী সমান অবদান রাখলেও তার পারিশ্রমিক পুরুষের থেকে কমিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নারী যখন অর্থনৈতিকভাবে সর্বত্র বিচরণ করছে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে অনেক জায়গায় নারী যখন প্রধানের চেয়ার অলংকৃত করে ভূমিকা রাখছে- তখন নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা তাদের সমৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আরেকটা হলো, নারী নিজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে তাকে পুরুষের কর্তৃত্ব করা সহজ হয়। কোনো পরিবারে যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হয়, স্ত্রীকে যখন স্বামী নির্যাতন করে, তখন নারী স্বাবলম্বী হলে নিজের পথ বেছে নিতে সমস্যা হয় না। বিপরীতে স্ত্রীকে মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে যেতে হয়। নারী আজ স্বাবলম্বী হওয়ার পথ ধরেই প্রতিবাদ করতে শিখছে। তারপরও তার চ্যালেঞ্জ অনেক। সরকার নারীকে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি দিলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হয় না। ছয় মাস ছুটি নিতে গেলে দেখা যাবে, সেখানে তার চাকরিই থাকবে না। আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেকই যেখানে নারী, সেখানে দেশের উন্নয়নের জন্য নারীকে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতেই হবে। তাদের বসিয়ে রাখা যাবে না। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মাধ্যমে পক্ষান্তরে তারা 'ডিমোরালাইজড' হয়ে যায়। সুতরাং দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই এসব অনাচার বন্ধ করা জরুরি।
আপাতদৃষ্টিতে আমরা দেখছি, দেশে রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে নারী নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু আসলে কতটা ক্ষমতায়ন হয়েছে। এটা সত্য যে, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি। সংসদে নির্বাচিত নারী এমপির চেয়ে সংরক্ষিত আসনের নারীর সংখ্যাই বেশি। রাজনৈতিক দলগুলোতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃত্বে হতাশাজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিই যেখানে আমাদের ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু, পৌরুষত্ব প্রদর্শনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম- সেখানে এভাবে নারীর পিছিয়ে থাকা প্রত্যাশিত নয়। এটা ঠিক যে, অনেকে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির সিঁড়ি হিসেবে রাজনীতিকে ব্যবহার করেন। সাহেদ, সাবরিনা কিংবা পাপিয়ার মতো অপরাধী রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তৈরি হচ্ছে। আমরা এই দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি চাই না।
সিলেটে ধর্ষণের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার খবর এসেছে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সেখানে ছাত্রলীগের কমিটি নেই। বন্ধ থাকা ছাত্রাবাস তাহলে কোন খুঁটির জোরে তারা দখল করেছিল? শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি- ছাত্রলীগের স্লোগান হলেও বারবার কেন তারা অপরাধের কারণে সংবাদমাধ্যমে খবর হয়ে আসছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। ধর্ষকের কোনো দল থাকতে পারে না। তারা কোনোভাবেই রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেতে পারে না। ইউএনও ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায়ও যুবলীগের নাম আসছে। অপরাধী যে-ই হোক, তার বিচার করতে হবে। আমাদের মনে আছে, সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজার ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত বদরুল কারাগারে গেছে। ছাত্রলীগ করলেও পার পায়নি।
আইনের কথা যদি বলি, ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে না হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধী পার পেয়ে যায়। মামলা দায়ের থেকে শুরু করে তিনটি ধাপে ধর্ষণের মামলা দুর্বল করে দেওয়া হয়; অপরাধী সাজা পাচ্ছে না। অন্তত তিন ধাপের গরমিলের মধ্য দিয়ে ধর্ষণ মামলা দুর্বল করা হয়। সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে সাক্ষীদের পিছিয়ে পড়ার প্রবণতাও রয়েছে। মূলত এসব কারণে ধর্ষণের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলেই বাংলাদেশে এক হাজারে মাত্র চারজন আসামি সাজা পায়। সরকারের তৎপরতায় ফেনীর নুসরাতের মামলা যেমন দ্রুত বিচার আদালতে সম্পন্ন হয়েছে, এখানেও সেটি জরুরি। আবার অনেক সময় দেখা যায়, অপরাধী প্রভাবশালী হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরতে গড়িমসি করে কিংবা ধরে ছেড়ে দেয়। এমনটি কাম্য নয়।
নারী নির্যাতন, ধর্ষণ চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জরুরি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটতে পারে। সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতেই হবে।
ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও অধ্যাপক সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- সমাজ
- ড. সাদেকা হালিম