ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ
ব্যক্তির বিচারই শেষ কথা নয়

জুলেখা আক্তার শিখা
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০
সন্দেহ নেই যে, সিলেটে প্রকাশ্যে ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে এক গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাটি যেমন নৃশংস তেমনই নারকীয়। সভ্য সমাজে অভাবিত এই অঘটন যে কেবল যৌন বিকৃতির কুফল নয়, বরং ক্ষমতা প্রদর্শনের উৎকট আয়োজন; গৃহবধূর স্বামীর দায়ের করা মামলার নয়জন আসামিই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত থাকা তার প্রমাণ। একই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, অঘটনের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাধুবাদযোগ্য দ্রুততার সঙ্গে সক্রিয় হয়েছে। আমরা দেখি, ধর্ষণের অনেক অপরাধেই অভিযুক্তরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও ঔদাসীন্যের কারণে মুক্ত ঘুরে বেড়ায়, এমনকি পারও পেয়ে যায়। আইন ও আদালতের দুয়ারে দুয়ারে বিচারপ্রাপ্তির আশায় ঘুরতে থাকে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ও তার স্বজনরা। মন্দের ভালো, গত শুক্রবার সংঘটিত আলোচ্য অঘটনের ক্ষেত্রে মঙ্গলবারের মধ্যেই এজাহারভুক্ত নয়জনের মধ্যে প্রধান আসামিসহ আটজনই আটক হয়েছে। সোম ও মঙ্গলবার পাঁচজনকে আদালতে তুলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ। আজ আটক বাকিদেরও জিজ্ঞাসবাদের অনুমতির জন্য আদালতে তোলা হবে ধারণা করা যায়। আমরা ভরসা রাখতে চাই যে, অবিলম্বে অবশিষ্ট আসামিকেও আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা দেখছি, স্থানীয় পুলিশ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের তদন্ত ছাড়াও মঙ্গলবার আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দুই সপ্তাহের মধ্যে কোনো ব্যর্থতা ছাড়াই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় যদিও আরও অনেকটা পথ যেতে হবে, আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে, সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অপরাধীরা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পাবে। বস্তুত শুক্রবারের ওই অঘটন প্রকাশ হওয়ার পর নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমও যেভাবে বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, শত হতাশার মধ্যেও তা আমাদের আশান্বিত না করে পারে না। এখন আমরা দেখতে চাইব, আক্রান্ত গৃহবধূ ও তার পরিবারের পাশেও একইভাবে দাঁড়িয়েছে পুলিশ, প্রশাসন ও সমাজ। অঘটনের শিকার গৃহবধূর শারীরিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাকে মানসিকভাবেও সাহস জোগাতে হবে। আমাদের রক্ষণশীল এই সমাজের পরিবার থেকেও তিনি যাতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পান, তাও নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়াও আক্রান্ত ও তার পরিবারের জন্য কম লড়াই ও সংগ্রামের নয়। এই দীর্ঘ লড়াইয়েও সবাইকে আক্রান্তের পাশে থাকত হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন বা অভিযোগপত্রে অনিচ্ছা বা ইচ্ছাকৃত ফাঁক থাকার কারণে অভিযুক্তদের শেষ পর্যন্ত আদালতের পক্ষে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে শুধু নয়, কোনো মামলার ক্ষেত্রেই আমরা এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। আশা করা যায়, চাঞ্চল্যকর এই মামলায় পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। আমরা এও দেখতে চাই, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মধ্য দিয়েই আমাদের সক্রিয়তা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ঐতিহ্যবাহী কলেজটি কেন বারবার অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটনের মুখোমুখি হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে নির্মোহভাবে। আলোচ্য ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। আমরা দেখতে চাই, যারই দায় ধরা পড়ূক না কেন তারই বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা। সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বৃদ্ধির যে নির্দেশনা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে দেওয়া হয়েছে, তা যেন সাময়িক না হয়। আলোচ্য ধর্ষণে অভিযুক্তদের যারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আশ্রয়-প্রশয় দিয়েছে, তাদেরও আনতে হবে আইনের আওতায়। অন্যথায় কিছুদিন পর একই পথ ধরে তৈরি হবে নতুন নতুন ধর্ষক। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। তারা কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেবেন না এবং অপরাধী তৈরির পথ খোলা রাখবেন না- অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও বিক্ষোভসঞ্চারী এই অঘটনের মধ্য দিয়ে সিলেটে সব দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এমন উপলব্ধি জরুরি।
- বিষয় :
- ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ