গণতন্ত্র
নির্বাচনী ব্যবস্থারই পুনর্নির্মাণ জরুরি

শারমীন মুরশিদ
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২০ | ১৩:৫৪
চলতি মাসের ১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় সংসদের ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচন। এর দু'দিন পর ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের দুই শতাধিক সাধারণ নির্বাচন ও বিভিন্ন পদে উপনির্বাচন। এই নির্বাচনগুলোতে তেমন আমেজ ছিল না, ছিল না সন্তোষজনক ভোটার উপস্থিতিও। কোথাও ৫ শতাংশ, কোথাও ১০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ ভোট পড়ে ছিল নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনে। সাম্প্রতিককালের এই নির্বাচনগুলো নিয়ে মানুষের আগ্রহও তেমন ছিল না। তবে থেমে ছিল না অনিয়ম-কারচুপি। ২১ অক্টোবর সমকালে প্রকাশিত 'জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, হামলা সবই ছিল' শিরোনামে উঠে এসেছে নির্বাচনের চিত্র। এতগুলো পরিষদের নির্বাচন এমন নিরুত্তাপ হবে, তা চিন্তাই করা যায় না। এই চিত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য স্বস্তিকর হতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে তা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ভোটারদের উপস্থিতি সব সময় বেশি দেখেছি। পৃথিবীর অল্প সংখ্যক দেশেই নির্বাচনে বাংলাদেশের মতো এত অধিক সংখ্যক ভোটারের স্বতঃস্ম্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে গড়ে ৮০ শতাংশের বেশি এবং জাতীয় নির্বাচনে গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতি ছিল। বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক সচেতন। তারা ভোট দিতে ভালোবাসেন। এক যুগ আগেও আমরা দেখেছি, ভোট এলে সব শ্রেণি-পেশার ভোটাররা দলবেঁধে ভোটকেন্দ্রে যেতেন ভোট দিতে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া বা চলাফেরা করতে অক্ষম ব্যক্তিরাও বিশেষভাবে বা অন্যের সহায়তায় আসতেন ভোটকেন্দ্রে। সর্বোপরি ভোটার, প্রার্থী, পর্যবেক্ষকসহ সংশ্নিষ্ট সবার অংশগ্রহণে বাংলাদেশে ভোট যথারীতি 'ভোটোৎসবে' পরিণত হতো। ভোটের সেই উৎসব আর দেখা যায় না। নির্বাচন প্রসঙ্গে মানুষের খুব বেশি আগ্রহ নেই। ভোটারদের মতো পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও ভোটের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ নেই। ভোটের চিত্র কেমন হতে পারে, সে ব্যাপারে আগেই সবাই এক ধরনের চিত্র দেখতে পায়। ভোট গ্রহণের পরে সেই চিত্র ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে তেমন পার্থক্য থাকে না। ভোটের ব্যাপারে এই অনীহা কেন? কেন হারাতে বসেছে ভোট উৎসব?
নির্বাচন-সংশ্নিষ্টদের অনেকেই বিশেষত নির্বাচন কমিশন বলছে, করোনার কারণে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। কিন্তু আমরা করোনা আসার আগে বেশকিছু নির্বাচনেও প্রায় ভোটার শূন্য ভোটকেন্দ্র দেখেছি। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের স্বতঃস্ম্ফূর্ত উপস্থিতির জন্য অনুকূল পরিবেশের দরকার হয়। এই পরিবেশ বদলে গেলে ভোটারদের মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা-না করার বিষয়ে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা যাবে এমন আস্থা ভোটারদের মধ্যে থাকলে তারা অবশ্যই ভোটকেন্দ্রে যাবে। মূলত নির্বাচন কমিশন ভোটারদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও তাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই বলা যায়, সাম্প্রতিককালের নির্বাচনগুলো বিগত নির্বাচনগুলোরই প্রতিফলন মাত্র। এমতাবস্থায় অনেকেই বলছেন, নির্বাচন কমিশন ও পুরো ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের ধারণা ইতিবাচক নয়।
নিঃসন্দেহে এই নির্বাচনগুলোতে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ ছিল না। ফলে মানুষ আগ্রহ দেখায়নি। আর যদি ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার মূলে করোনা হয়ে থাকে, তাহলে এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ভোটের আয়োজন কেন করল? ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে করোনার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল নির্বাচন কমিশনের। ৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে বিরল। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, কয়েক বছর ধরে এমনটিই হয়ে আসছে।
৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ ভোটারের ভোটে কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করা হাস্যকর ঘটনা বটে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোটারের চেয়ে কম উপস্থিতি হলে পুনর্নির্বাচন আয়োজন করার শক্ত যুক্তি থাকে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশে অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ভোটারের উপস্থিতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে পুনর্নির্বাচন আয়োজন করা উচিত ছিল। মাত্র ১০ শতাংশ ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের অর্থ হলো, ৯০ শতাংশ মানুষ ভোট দেয়নি বা ভোট বর্জন করেছে।
এই ১০ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তির জনপ্রতিনিধিত্বের শক্তি কেমন হবে? তাকে কি জনগণের ভোটে বিজয়ী বলা যায়?
রাজনৈতিক মহল, নাগরিক সমাজ, সাধারণ জনগণ ও সরকারি কর্মচারীসহ সবার আগ্রহ, উদ্যোগ ও ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি সুস্থ ধারা তৈরি হয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। এরপর কিছু আসনে উপনির্বাচন এবং কিছু স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনও ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এ অবস্থার স্খলন ঘটতে থাকে। গত ২০ বছরে আমরা যেমন সুষ্ঠু নির্বাচনী ধারার উত্থান দেখেছি, তেমনি পতনও দেখছি। ২০২০ সালে এসে আমাদের বলতে হচ্ছে, ভোট প্রদানে জনসাধারণের উৎসাহের যে ঐতিহ্য সেখানে ধস নেমেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা। এ দুটির কোনোটিই আমরা দেখছি না। আমরা হয়তো সুস্থ নির্বাচনী ধারা সংরক্ষণ করতে চাচ্ছি না।
দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যখন এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, তখন অনেকেই নির্বাচনী ব্যবস্থা 'রিফর্ম' করার কথা বলছেন। আমার প্রশ্ন, নির্বাচনী ব্যবস্থার কি কোনো 'ফর্ম' অবশিষ্ট আছে? যদি 'ফর্ম'ই না থাকে তাহলে 'রিফর্ম' করা যায় কীভাবে? নির্বাচন প্রসঙ্গে মানুষের মাঝে সংকোচ কাজ করে। এই সংকোচ থেকে তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। মনে রাখা দরকার, ভোটাধিকার মানুষের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার। বর্তমান নির্বাচনী প্রক্রিয়া মানুষের সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ও ভোটারদের আস্থা ফেরাতে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার নয়, বরং পুনর্নির্মাণ দরকার। চলমান পরিস্থিতিতে পুনর্নির্মাণের কাজটি যত কঠিন হোক না কেন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বার্থে তা আমাদের করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি থাকলে চলবে না। সব রাজনৈতিক দল আলোচনার মাধ্যমে একটি নির্বাচনী কাঠামো তৈরি করতে হবে। তবে শুধু নির্বাচনী কাঠামো তৈরি করলেই যথেষ্ট হবে না, তা সংরক্ষণের ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে সব পক্ষকে।
নির্বাহী পরিচালক, ব্রতী
- বিষয় :
- গণতন্ত্র
- শারমীন মুরশিদ