ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

উন্নয়নের অগ্রযাত্রা এবং অসংক্রামক রোগ

উন্নয়নের অগ্রযাত্রা এবং অসংক্রামক রোগ

ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক, অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২০ | ১৫:৪২

পৃথিবী আজ এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নতুন ধরনের সংক্রামক রোগ কভিড-১৯-এর কারণে নানামুখী সংকটে পড়েছে বিশ্ব। অনেক দেশেই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্নথ হয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা হলো, এসব সংকট সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ এখনও এগিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে (ডব্লিউইও) বলা হয়েছে, চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চাইলে আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে আরেকটি দিকে আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলো সুস্বাস্থ্য। কারণ, ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতা একসূত্রে গাঁথা।

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমবর্ধমান অসংক্রামক রোগসমূহ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ ইত্যাদি। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশে এসব রোগ বড় ধরনের বোঝা। কারণ, এই রোগগুলোর চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং এসবে একবার আক্রান্ত হলে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা বা কর্মক্ষমতা কমে যায়। সূক্ষ্ণভাবে দেখলে, এটা পুরো দেশের উন্নতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এনসিডি কান্ট্রি প্রোফাইল ২০১৮ অনুসারে, অসংক্রামক রোগে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট মৃত্যুর ৬৭ ভাগের জন্য দায়ী বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ। শুধু হৃদরোগেই ৩০ ভাগ মৃত্যু হয়ে থাকে।

বিশেষত তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা কমার পেছনে অন্যতম কারণ নানা রকমের অসংক্রামক রোগ। বাংলাদেশে ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের মধ্যে চার ধরনের অসংক্রামক রোগ- হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগে মৃত্যুর আশঙ্কা ২২ শতাংশ।

অসংক্রামক রোগসমূহের পেছনে নানা রকম কারণ থাকে- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যেমন : অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাদ্য গ্রহণ; অল্প পরিমাণে ফল ও শাকসবজি খাওয়া, তামাক ব্যবহার, কায়িক শ্রমের অভাব, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং বায়ুদূষণ ইত্যাদি। এই ঝুঁকিগুলোর প্রায় সবই মূলত আমাদের জীবনাচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের পরিবর্তিত জীবনাচরণের ফলে দিন দিন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। আর কোনো দেশের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জনের পথে এসব দীর্ঘমেয়াদি ও দুরারোগ্য রোগসমূহ নিশ্চিতভাবেই একটি বাধা।

আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- এসডিজি অর্জনের জন্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি হ্রাস করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা। এজন্য রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণেও জোর দিতে হবে। দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা মূলত চিকিৎসাসেবা নির্ভর। অথচ স্বাস্থ্যকর জীবনাচরণের জন্য জনসচেতনতা বাড়ানো হলে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ অনেকটা কমানো সম্ভব। তবে সচেতনতা বাড়ানোই শেষ কথা নয়, সেই সঙ্গে কিছুক্ষেত্রে যথাযথ আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নও জরুরি।

তামাক বিশ্বজুড়ে পুরুষদের জন্য অন্যতম ঝুঁকির কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের আধিক্য নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী রোগ, ক্যান্সার, যক্ষ্ণা এবং অন্যান্য শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণজনিত রোগের পেছনে দায়ী তামাক ব্যবহার। বলে রাখা ভালো, পরোক্ষ ধূমপানও এসব রোগের পেছনে দায়ী।

বাংলাদেশে গত এক দশকে তামাক ব্যবহারের হার হ্রাস পেয়েছে; তবে এখনও এর পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বেশি। তাছাড়া এখনও এদেশে রেস্টুরেন্টে ৫০ শতাংশ, গণপরিবহনে ৪৪ শতাংশ, কর্মক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ, এমনকি হাসপাতালেও প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে অসংক্রামক রোগসমূহ প্রতিরোধের জন্য তামাক ব্যবহার ও তামাকজনিত স্বাস্থ্যক্ষতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে হবে। এক্ষেত্রে উলেল্গখ্য, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বেশকিছু দুর্বলতা রয়েছে। যার ফলে আইনটি কার্যকরভাবে তামাকজনিত ক্ষতি রোধে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা হলে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।

এর পাশাপাশি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, শিল্পজাত খাদ্যে লবণ ও ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নির্ধারণ করা ইত্যাদি নীতিমালা প্রণয়ন ও যথাযথ বাস্তবায়ন জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মূলত এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করতে তৃণমূল থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা পর্যন্ত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। যেখানে একই সঙ্গে রোগগুলোর প্রতিরোধমূলক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে। যেমন :উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো রোগগুলো প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা গেলে পরবর্তী সময়ে অনেক বড় ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এজন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কিছু রোগ নির্ণয় ও ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হলে অসংক্রামক রোগের চিত্র অনেকটা পাল্টে যেতে পারে।

নীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি সমন্বিত এসব নানা উদ্যোগ অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে, যেখানে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা জনস্বাস্থ্যবান্ধব নীতি প্রণয়নে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। নীতিনির্ধারক হিসেবে তারাই পারেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে।

লেখকদ্বয় যথাক্রমে জাতীয় অধ্যাপক :সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং সংসদ সদস্য :চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন

আরও পড়ুন

×