স্মরণ
তার শূন্যতা পদে পদে

কাইয়ুম চৌধুরী [১৯৩২-২০১৪]
রফিকুন নবী
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ১৫:৪৩
কাইয়ুম চৌধুরীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দেখতে দেখতে ছয়টি বছর পার হয়ে গেল কাইয়ুম ভাইকে হারানোর। দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। তার কর্মকাণ্ডের পরিধি চতুর্দিকে এত বিস্তৃত ছিল যে, সেখানে বিরাট শূন্যতা রয়ে গেছে গত ছয় বছর ধরে। আমরা পদে পদে তার শূন্যতা অনুভব করি।
রং ব্যবহারের নিজস্ব ধরন, নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি ও নতুন নতুন চিন্তার মাধ্যমে পেইন্টিংকে সমৃদ্ধ করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। তার চিত্রকলায় যা ফুটে উঠত, সেই নতুন নতুন ধারণা আমরা আর পাই না। কাইয়ুম চৌধুরীর কর্মের বৃহত্তর ক্ষেত্র ছিল পুস্তকের গ্রাফিক্স জগৎ। সেখানে তিনি ছিলেন একচ্ছত্র অধিপতি। তার প্রচ্ছদ, ডিজাইন মডেল, লোগো, মনোগ্রাম, নকশা তৈরির ভাবনা ছিল অনন্য। গত ছয় বছর ধরে আমরা এসব থেকে বঞ্চিত। তার প্রয়াণ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে। সেই শূন্যতা বিশেষভাবে অনুভব করেন আমাদের লেখক, সাহিত্যিক ও প্রকাশকরা। কারণ এক সময় তারা কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ ছাড়া বই প্রকাশ করতে পারতেন না।
কাইয়ুম চৌধুরী শুধু চিত্রকলা চর্চার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিজাইন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। নতুন প্রজন্মের চিত্রকলা শিল্পীদের অনেকেই তার ছাত্র। ফলে তাদের কাজে ও ভাবনা-চিন্তায় কাইয়ুম চৌধুরীর ছায়া পরিলক্ষিত হয়। কাইয়ুম চৌধুরী একজন আন্তর্জাতিক মানের চিত্রশিল্পী ছিলেন। তার কাজের মান বিদেশি যে কোনো শিল্পীর কাজের সমমানের বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়েও ভালো মানের।
কাইয়ুম চৌধুরী দেশের সাংস্কৃতিক জগতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। নানানভাবে জড়িয়ে ছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে। তার সাংগঠনিক ভাবনা-চিন্তা ছিল প্রখর। তিনি কণ্ঠশীলন আবৃত্তি সংসদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯ সালের পরে তিনি চারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধসহ অন্যান্য আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং শিল্পীদের পরিচালনা করতেন। কাইয়ুম ভাই তার ত্যাগ ও কর্মগুণে পরবর্তীকালে শিল্পকলার যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক লাভের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। শুধু ছবি বা প্রচ্ছদ আঁকার দক্ষতার ওপর কাইয়ুম চৌধুরীকে মূল্যায়ন করা যায় না। তাকে মূল্যায়ন করা বা শ্রদ্ধা জানানোর বহু দিক বিরাজমান।
কাইয়ুম চৌধুরী একজন রুচিশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি সংগীত পছন্দ করতেন। নিজেও গান গাইতে পারতেন। তার গানের গলাও ভালো ছিল। আমাদের আড্ডায় তিনি মাঝে মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তিনি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের খুব ভক্ত ছিলেন, বিশেষ করে রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত ও পুরোনো দিনের গানের। বহু গানের রেকর্ড তিনি সংগ্রহে রেখেছিলেন। আমরা এখনও তার এই দিকটি অনুসরণ করার চেষ্টা করছি।
কাইয়ুম চৌধুরীকে আমি সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাইনি। কিন্তু তার সারাজীবনের কর্মকাণ্ড, তার রুচি এত আকর্ষণীয় ছিল যে, আমি তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম। তিনিও তা জানতেন। কবে কোথায় কোন গান প্রকাশ হচ্ছে তিনি তার খোঁজ রাখতেন। অনেক সময় আমাদের মাধ্যমে সেগুলো সংগ্রহ করতেন।
নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। চিত্রশিল্প, শিক্ষকতা, সংগীতের পাশাপাশি লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এর প্রমাণ মেলে তার লেখা ছড়া, আত্মজীবনী ও প্রবন্ধগুলোতে। হয়তো এখনও অপ্রকাশিত অনেক পাণ্ডুলিপি পড়ে আছে তার বাড়িতে। তিনি একসময় সিনেমার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ষাটের দশকে আমাদের দেশে সিনেমার সূচনা হয়। ওই সময় যারা অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক ও কলাকৌশলী ছিলেন, তাদের সঙ্গে কাইয়ুম ভাইর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি বিদেশি সিনেমারও ভক্ত ছিলেন। সিডি-ক্যাসেট জোগাড় করে দেখতেন ভালো ভালো সিনেমা। সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন কাইয়ুম ভাইয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে চলাফেরা করতেন, বহু কাজ করেছেন একসঙ্গে। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে একটি সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজও করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী।
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি জগতের সবদিকেই কাইয়ুম চৌধুরীর সম্পৃক্ততা ছিল। শিল্পীদের অত্যন্ত কাছের ও প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। শিল্পীদের সংকট-সম্ভাবনায় তিনি যে পরামর্শ দিতেন, তা খুবই গ্রহণযোগ্য ছিল। সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও বেশ কিছু কাজ করেছেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছেন ওতপ্রোতভাবে। বিশেষ করে রুচিশীল ম্যাগাজিনগুলোর সঙ্গে তার গভীর সম্পৃক্ততা ছিল। কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের কাছে তিনি ছিলেন বিশিষ্টজন। তাকে বাদ দিয়ে কোনো কিছু ভাবা যেত না। তার মৃত্যুর পর আমরা এসব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছি এবং তার শূন্যতা এখনও রয়ে গেছে। কাইয়ুম ভাইর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে গভীরভাবে স্মরণ করছি; বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
চিত্রশিল্পী
- বিষয় :
- স্মরণ
- রফিকুন নবী