সুনীল অর্থনীতি
সমুদ্রের সম্ভাবনা কাজে লাগান

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:১১
ব-দ্বীপ বাংলাদেশের একদিকে রয়েছে সুজলা সুফলার উর্বর সমারোহ; অন্যদিকে বিশ্বখ্যাত বহু নদী বা সমুদ্রের বিশাল জলতরঙ্গের নান্দনিক ও শ্রুতিমধুর প্রতিধ্বনি। স্রষ্টার অপার কৃপায় অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এদেশ। কিন্তু কথিত প্রাগ্রসর ঔপনিবেশিক শক্তির কূটচাল-নিপীড়ন-নির্যাতনের ফলে শুধু অনুন্নয়ন বিস্তৃত হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের উদ্ভাবনী পন্থা অবলম্বনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কোনো সময়ে পরিলক্ষিত হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র অর্জনের পর যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, পঁচাত্তরের কালো অধ্যায়ের পর তা নেমে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার এর শুভ সূচনা হয়। ইতোমধ্যে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আইনি যুদ্ধে জয়ী হয়ে বিগত বেশ কয়েক দশকের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় দেশ সফল হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল'স অব দ্য সি'স (ইটলস) এবং ২০১২ সালে ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক আদালত পিসিএ কর্তৃক ঘোষিত রায়ের মাধ্যমে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও অধিক সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। এ সাফল্যগাথায় সমুদ্র সম্পদকে যথাযথ আহরণ, ব্যবহার ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিমান করার অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এখন সমুদ্র অর্থনীতি (ব্লু-ইকোনমি) সংশ্নিষ্ট গবেষণা ও সম্পদ আবিস্কার-আহরণ-প্রয়োজনীয় ব্যবহার এবং দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এর সুফল ঘরে তুলতে হবে।
প্রাসঙ্গিকতায় জাপান-চীনসহ অনেক দেশের সমুদ্র সম্পদের ব্যবহারকে দৃষ্টান্তরূপে দেখা যেতে পারে। জাপানের ভোজন সংস্কৃতিতে 'নরি' খ্যাত উপাদেয় বস্তুটি সমুদ্রে ভাসমান নরম শ্যাওলা থেকেই আবির্ভূত। এটি কিন্তু উদ্ভিদ জাতীয় কোনো অপ্রাণিজ সম্পদ নয়। সমুদ্রের এই শ্যাওলাকে যথাযথ প্রক্রিয়াজাত করে জাপানের বিখ্যাত খাদ্য তথা সুশি-নরি মাখি-অনিঙ্গিরি-নুডলস জাতীয় সব খাবারে এই নরির ব্যবহার শুধু উপাদেয় নয়; সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারে উৎকৃষ্ট উপমাও বটে। প্রাণিজ সম্পদের মধ্যে শামুক-ইকা-অক্টোপাসসহ বহু ধরনের সুস্বাদু মাছ আমাদের সমুদ্রসীমায় প্রচুর পরিমাণে প্রজনন ও সংগ্রহ করার সুযোগ থাকলেও জাপানি-চীনাদের মতো এসব প্রোটিনযুক্ত খাবারগুলোকে অবজ্ঞা করে সমগ্র সমুদ্র অর্থনীতি কোনোভাবেই প্রাঞ্জল করা যাবে না।
২০১৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১২তম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়' এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সদর দপ্তরের সহায়তায় 'বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' (রিমরাড) প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যই ছিল সমুদ্র অর্থনীতির সমৃদ্ধকরণে প্রত্যক্ষ গবেষণা-জ্ঞানসৃজন-উপযোগী মানবসম্পদ উৎপাদন এবং সমুদ্র সম্পদের সুরক্ষা-আহরণ-সংরক্ষণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন।
মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে 'ব্লু-ইকোনমি সেল' গঠন করে সমুদ্র সম্পদ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছে। ওই সূত্রমতে জানা যায় যে, বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। এ ছাড়া চীন, জাপান, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট আয়তনের কাছাকাছি সমুদ্র অঞ্চল অর্জিত হয়েছে। সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জন করেছে। এর মধ্যে একটি হলো প্রাণিজ, আরেকটি অপ্রাণিজ। প্রাণিজের মধ্যে রয়েছে, মৎস্য সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা-গুল্মলতা ইত্যাদি। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে চারটি মৎস্য ক্ষেত্র। সেখানে ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, সাত প্রজাতির কচ্ছপ, পাঁচ প্রজাতির লবস্টার, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিনসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস রয়েছে। আরও রয়েছে ইসপিরুলিনা নামক সবচেয়ে মূল্যবান আগাছা। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ যেমন- তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালি। যেমন- জিরকন, রুটাইল, সিলিমানাইট, ইলমানাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিকোক্সিন ইত্যাদি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুপূর্ণ।
সমুদ্রসৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। সমুদ্রসীমা বিজয়ের আট বছরে বাংলাদেশের অর্জনের মধ্যে রয়েছে ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির সঙ্গে দুটি অগভীর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসের সঙ্গে গভীর ব্লক ১১ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্কো-দাইয়ুর সঙ্গে গভীর ব্লক ১২-এ তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য অপ্রাণিজ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের চুক্তি হয়েছে। 'বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০' মহাপরিকল্পনায় সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব বিবেচনায় পাঁচ ধরনের কর্মকৌশলও নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র সম্পদ আহরণে কার্যকর জরিপ-গবেষণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র সম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২০২৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অক্লান্ত কর্মযোগী প্রচেষ্টায় ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে যৌক্তিক ব্যয়ভার বহনে সমুদ্র অর্থনীতিকে সুসংহত ও সচল করে 'বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন' ব্রতে দেশ ও সরকার আত্মপ্রত্যয়ী হবে- দেশবাসীর মতো আমিও এই প্রত্যাশাটুকু ব্যক্ত করছি।
শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়