ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

প্রযুক্তি

ফাইভজি দুনিয়ায় আমরা কোথায়

ফাইভজি দুনিয়ায় আমরা কোথায়

শাইখ সিরাজ

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:১৭

আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস। চতুর্থবারের মতো আয়োজিত হচ্ছে দিবসটি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় আমরা দেখছি এক ডিজিটাল বাংলাদেশ। গত এক যুগে যে গতিতে বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে তা সত্যিই অভাবনীয়। ভেবে ভালো লাগে বাংলাদেশ বৈশ্বিক ডিজিটাল অগ্রগতি থেকে একটুও পিছিয়ে নেই। অদম্য গতিতে আমরা চলেছি তথ্যপ্রযুক্তির এক মহাসড়ক ধরে। আমাদের এতসব সাফল্যগাথা রয়েছে এই খাতে যা সত্যিই গৌরবের। বিশেষত বাংলাদেশকে একটি ডিজিটাল দেশ হিসেবে সারা বিশ্বের বুকে পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের কর্মযজ্ঞ অসামান্য। এই তো সেদিনের কথা। ২০১৭ সালের নভেম্বরের কোনো এক দিনে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের শালডাঙ্গা থেকে কাজ সেরে সন্ধ্যারাতে গ্রামের পথ ধরে ফিরছিলাম শহরের দিকে। নীরব-নিস্তব্ধ-সুনসান গ্রাম। গাড়িতে আমি ও আমার সহকর্মীসহ চারজন। গ্রামের সরু পাকা পথের বুকে শুধু গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এরই মধ্যে চোখে পড়ল দূরে একটি ভবনে জানালা দিয়ে বিদ্যুতের আলো। ক্রমেই এগিয়ে গিয়ে দেখলাম শালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ। আগ্রহ নিয়েই যাত্রাপথে বিরতি দিয়ে ঢুকলাম পরিষদ ভবনে। উদ্দেশ্য দোতলার কক্ষটিতে জ্বলতে থাকা আলোর সন্ধান। গিয়ে দেখি এক তরুণ চেয়ারে বসে কম্পিউটারে কাজ করছে। তার সামনে মাঝবয়সী এবং বৃদ্ধ মিলে তিনজন গ্রামের সাধারণ কৃষক বসে আছেন। কথা বলে জানতে পারলাম কৃষি তথ্য সেবা নেওয়ার জন্য তারা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে এসেছেন। আনন্দে আমার বুকটা ভরে গেল। তাদের সাথে কথা বলতে বলতেই মনে হলো, ২০১৬ সালে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহর থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরে এলিখোম এলাকায় কাজে গিয়েছিলাম। কাজের বিরতিতে আমার সহকর্মীসহ সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হেলেন রুইসহ একটি রেস্তোরাঁয় বসে কোনোভাবেই ইন্টারনেট সংযোগ পাচ্ছিলাম না। কারণ মোবাইল নেটওয়ার্ক পাইনি আমরা তখন। আর বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রগতি সেই ২০১৭ সালেই আমাকে বিস্মিত করেছিল শালডাঙ্গার এক নিঝুম গ্রামে।

এবারের ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'যদিও মানছি দূরত্ব, তবুও আছি সংযুক্ত'। করোনা মহামারিকে মাথায় রেখেই হয়তো এত সুন্দর এবং অর্থবহ এই প্রতিপাদ্যটি ব্যবহার করা হয়েছে।

আমার কাজের ক্ষেত্র কৃষি। কৃষি সাংবাদিকতার চোখে আমি দেখেছি বাংলাদেশ। এই বিশ্বের অনেকগুলো দেশ আমার কাজের ক্ষেত্র হয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে কৃষির সফল উদাহরণ তুলে ধরেছি আমার দেশের কৃষকের জন্য, নীতিনির্ধারকের, কৃষি খাতের জন্য। শুধুই কৃষকের সফলতার গল্প বলেছি তা নয়, বলেছি কৃষিবাণিজ্য, কৃষির উন্নয়ন এবং সর্বোপরি কৃষিপ্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে। হৃদয়ে মাটি ও মানুষের অনেক পর্বেই দেখানোর সুযোগ হয়েছে কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারে কীভাবে একটি কৃষি খামার এগিয়েছে- সে হোক চীন কিংবা নেদারল্যান্ডস বা আমেরিকায়। ভালো লেগেছে বাংলাদেশেও প্রযুক্তির হাওয়া বেশ জোরেশোরেই লেগেছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির পথ ধরে কৃষির সম্ভাবনার দ্বারগুলো আরও খুলে দিতে সবসময় উদগ্রীব এই ডিজিটালাইজেশন।

দেখুন এখানে আর একটি বিষয় বলতে চাই। বেশ ক'দিন যাবতই শোনা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী ফাইভজির আগমনী বার্তার কথা। কোরিয়াতে শুরুও হয়েছে ইতোমধ্যে। কাজ করতে গিয়ে সিউলে তার কিঞ্চিৎ প্রসার দেখেছি। কোরিয়া সরকার চাইছে ২০২২ সালের মধ্যে তাদের ২০ ভাগ খামারকে স্মার্ট ফার্মিংয়ের আওতায় নিয়ে আসবে। ধীরে ধীরে হয়তো সব দেশেই ফাইভজি সুবিধা আসবে। তবে এটিও বলে রাখা প্রয়োজন যে, পৃথিবীর অনেক দেশেই কিন্তু এখন পর্যন্ত থ্রিজি এবং ফোরজি পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। আমরা ইতিবাচকভাবেই এ বিষয়টি দেখছি। এই সময়টি আধুনিক বটে, তবে এই আধুনিকতার পেছনে একটি বড় ভূমিকা রাখছে মোবাইল-ইন্টারনেট। পৃথিবী এখনও পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট যুগে সেভাবে প্রবেশ না করলেও ধারণা করা হচ্ছে এই ফাইভজি বিশ্বে প্রযুক্তির ব্যবহার অনেকটাই পাল্টে দেবে।

কেউ কেউ বলছেন ফাইভজির যুগ অন্য সবকিছুকেই গ্রাস করে ফেলবে। প্রশ্ন হচ্ছে নতুন মোবাইল প্রযুক্তি ফাইভজি কি টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্পকে গ্রাস করবে? টেলিভিশন হুমকির মুখে পড়েছে এ নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে তার পেছনের একটি কারণ হচ্ছে ফাইভজির দ্রুতগতির কল্যাণে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট নির্মিত হবে। আর তাই গ্রাহক খুব সহজেই একটি কনটেন্ট বাফার করে নিতে পারবে এবং অনায়াসে অফলাইনে কনটেন্ট রেখে তা পরে উপভোগ করতে পারবে। গ্রাহক স্বাধীনতাই এখন প্রধান বিষয়। মানুষ এই ডিজিটাল বাংলাদেশে বসে এখন শুধুই দ্রুতগতির ইন্টারনেটের পেছনে ছুটছে তা নয়, বরং ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে কী বাণিজ্য সম্ভাবনা রয়েছে তা নিয়েও পরিকল্পনা করছে। যা ইতোমধ্যে করোনা মহামারির এই কঠিন ও দুঃসহ সময়ে আমরা দেখছি বাসা থেকে অফিস পর্যন্ত অনলাইন মার্কেটিং এবং যোগাযোগ কী পরিমাণ প্রভাব ফেলেছে। ইন্টারনেট আমাদের সার্বক্ষণিক বন্ধু তা প্রমাণ করে দিয়েছে। তবে ফাইভজির সহযোগিতায় সম্প্রচারের ক্ষেত্রে টেলিভিশন সুবিধাও পাবে বৈকি। সেটি প্রযুক্তিগত দিক থেকে আপাতদৃষ্টিতে। যে সি-ব্যান্ডে স্যাটেলাইটে আপলিঙ্ক করা হয় টেলিভিশনের সম্প্রচার, সেই সি-ব্যান্ড যদি হাতছাড়া হয়, তাহলে ঘটবে কঠিন ঘটনা। স্পেকট্রাম হারিয়ে ফেলতে পারে টেলিভিশন। আমরা সবাই জানি, টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে স্পেকট্রামই সব। টেলিভিশনের জন্য যে স্পেকট্রাম রয়েছে তা যদি হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে এই শিল্পের সম্প্রচার সংকটের মুখে পড়তে পারে। কারণ মোবাইল অপারেটরদের কাছে গিয়েই যে জমা হবে হাতছাড়া স্পেকট্রাম। যেহেতু ফাইভজির জন্য বেশি স্পেকট্রামের প্রয়োজন, তাই প্রযুক্তি বিস্তারে কাজটি চলে যাবে মোবাইল অপারেটরদের হাতের মুঠোয়। কারণ সব বিনোদন, সব তথ্য এখন আপনার ওই হাতের মুঠোফোনটিতে, যা আপনার সার্বক্ষণিক চাহিদার সঙ্গী। এককভাবে তখন মোবাইল অপারেটররা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলেই মনে হচ্ছে। বাণিজ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে আরও গভীরে ভাবতে হবে আমাদের এবং রাষ্ট্র ও মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে একটি উইন-উইন অবস্থানে এসেই চিন্তা করতে হবে যাতে একপেশে কল্যাণের জায়গায় বহুমুখী কল্যাণ সাধিত হয়।

টেলিভিশন শিল্প যেন হুট করে মুখ থুবড়ে না পড়ে তা নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশের বিকাশে টেলিভিশন সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং দায়িত্বের সঙ্গেই সেটি করেছে। ফাইভজির মান নির্ধারণ বিষয়ে আইটিউর (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) সঙ্গে আলোচনায় বসছে নেটওয়ার্ক অপারেটর এবং টেলিভিশন সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ। বিবিসির মতো বড় টেলিভিশন সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান এই আলোচনায় টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্পের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছে। চেষ্টা, তদবির চলছে যেন টেলিভিশনের জন্য ফাইভজির স্পেকট্রামের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ পাওয়া যায়। পাওয়া গেলে, টিভি সম্প্রচারক মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের ওপর  নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হবে।

নীতিগত এবং বাণিজ্যিক বিষয়গুলো নিয়ে আরও গভীরে ভাবতে হবে রাষ্ট্রকে। ভাবতে হবে টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্প এবং মোবাইল অপারেটরদের দিকগুলোও। ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসের এই দিনে আমরা বলতে চাই, পঞ্চম প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হোক। তবে এ নিয়ে কোনো অস্থিরতা যেন টেলিভিশন শিল্পকে হুমকির মুখে না ফেলে। আমরা সবাই ডিজিটাল বাংলাদেশের উন্নয়নমুখী যাত্রার সারথি। বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশে যে অসাধারণ উন্নয়নের পথ রচনা করেছে গত এক যুগে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আর এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ, এ কথা বলাই বাহুল্য। আরেক উদ্যমী ও চৌকস তরুণের কথা বলতেই হয়। তিনি হচ্ছেন তথ্য ও যোগাযোগ অধিদপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। মানুষ থেকে প্রতিষ্ঠানে আজ যে ডিজিটাল জয়যাত্রা আমরা দেখছি, তার জন্য বিনীত ধন্যবাদ দিতে চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এবং যারাই এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের সবাইকে। আমরা আশা করি ডিজিটাল খাতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। বিজয়ের এই মাসে এই হোক আমাদের সবার একান্ত প্রত্যাশা।

কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

আরও পড়ুন

×