ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী

আমরা তোমাদের ভুলব না

আমরা তোমাদের ভুলব না

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:২৯

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালায়, বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা ওই মর্মান্তিকতাকেও ছাপিয়ে যায়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস তাই আমাদের কাছে বেদনাবিধুর এক শোকের দিন। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে ফেলার লক্ষ্যে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসররা মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে। ঢাকায় সেদিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর তারা রায়েরবাজার ও মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে লাশ ফেলে রেখে যায়। বস্তুত ২৫ মার্চ কালরাত থেকেই অন্যদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের যে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল, এই পরিকল্পিত ছকের চূড়ান্ত রূপ ছিল ওই বর্বরতা। বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীরা কেবল ঠান্ডা মাথার খুনিই নয়, সভ্যতারও শত্রু। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে জ্ঞান-বিজ্ঞান কাঠামো গড়ে তুলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের হত্যা করে এই যুদ্ধাপরাধীরা সেই স্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বিনষ্ট করতে চেয়েছে।

কয়েক বছর ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্য বয়ে নিয়ে আসছে। কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা তাদের রক্তের ঋণ বিলম্বে হলেও শোধ করতে পারছি। মুক্তিযুদ্ধের সুদীর্ঘ সাড়ে চার দশক পর জাতি স্বস্তির সঙ্গে দেখছে, ওই ঘৃণ্য নীলনকশা বাস্তবায়নে খল নেতৃত্ব দেওয়া আলবদরের শীর্ষ নেতারা কৃতকর্মের ফল পেয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে যুক্তরাজ্য প্রবাসী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আশরাফুজ্জামান। এই দণ্ডিতদের ফেরত আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে যেমন আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি সংশ্নিষ্ট দুটি দেশও বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে সহযোগিতার হাত বড়িয়ে দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দুটি দেশই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে যেহেতু সোচ্চার, সেহেতু আদালতে দণ্ডিত মানবতাবিরোধীদের আশ্রয় দেওয়া তাদের অবস্থানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও আদালতের রায়ে ঘোষিত দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দায় মোচনের যে যাত্রা শুরু করেছিল, এর শেষ ধাপে পৌঁছতে দণ্ডিত পলাতকদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতেই হবে। এ বছর এমন সময়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এসেছে, যখন আমরা দেখছি দেশে একটি চক্র 'ভাস্কর্য' বিতর্ক শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে উগ্রবাদীরা। আঘাত করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্যেও। ইতোমধ্যে সারাদেশে এদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রগতিমনস্ক মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে-এটি আশার কথা। আমরা মনে করি, এ সময়ে ভাস্কর্যবিরোধী ফতোয়া আর একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্ররোচনার ধরনে কোনো পার্থক্য নেই। আমরা চাই, প্রগতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকুক। আমরা দেখেছি, এই ভূখণ্ডের মানুষ বারবার যেমন বিদেশি শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছে, তেমনই সাহিত্য, শিল্প, সাংবাদিকতা, সংগীতে প্রমাণ করেছে নিজেদের প্রাধান্য। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আমাদের দমিয়ে রাখতে চাইলেও দুর্দমনীয় বাঙালি যেমন তার সাহস, দেশপ্রেম ও নেতৃত্বের গুণে বিজয় এনেছে, তেমনি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকাও কম নয়।

বাঙালি ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার শোককে শক্তিতে পরিণত করে সামনে এগিয়ে গেছে। তারা যে অবদান ও শিক্ষা রেখে গেছেন, তা আজও আমাদের পথ দেখাচ্ছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠা বাংলাদেশ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা, মননশীলতা, অগ্রসরমানতা, সক্রিয়তায় আরও ঋদ্ধ হয়ে অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শূন্যতা জাতির জন্য যেমন অপূরণীয় ক্ষতি, তেমনি তাদের পরিবারের জন্যও অনিঃশেষ বেদনার। আজ প্রেরণার বাতিঘর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমরা তোমাদের ভুলব না...।

আরও পড়ুন

×