ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

কৃষি

ফসলি মাটি বিক্রির ফাঁদ

ফসলি মাটি বিক্রির ফাঁদ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার জামতলা গ্রামে মতিউর রহমানের বাগানে ধরেছে কমলা - লেখক

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ১৫:৪৭

পারস্যের ওমর খৈয়াম থেকে বঙ্গের লালন সাঁই- সবাই যদিও নগদ লাভের পক্ষে সওয়াল করেছেন; কৃষির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হতে পারে না। হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সম্পদ মুহূর্তের অবিমৃষ্যকারিতায় কীভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কৃষিতেই তার নজির সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। শনিবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে- কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় ফসলি জমির ওপরের অংশের মাটি বা 'টপ সয়েল' বিক্রি করে দিচ্ছে কৃষক। সর্বনাশা এই চিত্র নতুন নয়, কেবল কিশোরগঞ্জ বা বৃহদার্থে হাওর অঞ্চলেরও নয়। গত ডিসেম্বরেই সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে আমরা দেখেছিলাম, এমন মাটি কেটে বিক্রি হওয়ায় ঢাকার ধামরাই অঞ্চলের সার্বিক কৃষি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। সমকালেই গত অক্টোবরে প্রকাশ হয়েছিল কুমিল্লার মুরাদনগরের অভিন্ন চিত্র। বস্তুত প্রায়শই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ ধরনের খবর সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখা যায়। এর অভিন্ন বিপদও অজানা নয়। আমরা জানি, ফসল উৎপাদনের জন্য শতকরা ৫ ভাগ যে জৈব উপাদান থাকা দরকার, তা সাধারণত মাটির ওপর থেকে ৮ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত থাকে। মাটির কর্ষণস্তরেই থাকে চাষ করা উদ্ভিদের মূল খাদ্যভান্ডার। 'টপ সয়েল' কেটে নিলে কেঁচোসহ উপকারী পোকামাকড়ও নষ্ট হতে বাধ্য। ফলে ওই জমিতে সহজে ফসল জন্মে না। ফসল হলেও তার ফলন হয় নগণ্য।

নিকলীতেই যে অঞ্চলে এভাবে ফসলি মাটি বিক্রি হচ্ছে, তার পাশেই দেখা গেছে এমন নজির। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না মূলত সাময়িক লাভের জন্য। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছর উৎপাদিত ধানের উপযুক্ত দাম না পেয়ে জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাওয়া কৃষক এই আত্মঘাতী পদক্ষেপ বেছে নিয়েছে। বলা বাহুল্য, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এমন 'প্রয়োজন' দেখা যায়। কিন্তু এর জের ধরে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, গোটা দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার জন্যই উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আমাদের মনে আছে, গত বছর আগস্টে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী যে কোনো কাজে টপ সয়েল ব্যবহারে সার্বিক নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি তুলেছিলেন। তার এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ ছিল যে, এমনকি বাঁধ নির্মাণসহ সরকারি ভরাট কাজেও মাটির উৎপাদনক্ষম অংশের যথেচ্ছ অপব্যবহার হচ্ছে।

বিশেষভাবে বলতে হবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও স্থাপিত হাজার হাজার ইটভাটার মাটি-ক্ষুধার কথা। নিকলীর মাটিও যাচ্ছে ইটভাটায়। এই অভিযোগও আমলযোগ্য, সাময়িক আর্থিক সংকটে পড়া কৃষককে ইটভাটার লোকজন ফসলি মাটি বিক্রিতে প্রলুব্ধ করছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের প্রায় প্রত্যেক জনপদে কৃষি জমি এভাবে ইটভাটার বিরূপ প্রভাবের শিকার। অস্বীকার করা যাবে না যে, বর্তমান সভ্যতায় কংক্রিটাইজেশনের যে জোয়ার চলছে, তা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু প্রতিবেশসম্মত উপায়েও যে নিরাপদ ও আরামদায়ক আবাস তৈরি সম্ভব, গৃহনির্মাণের প্রাকৃতিক উপকরণে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে সে চিন্তা আরও ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। বিশেষত অমূল্য ফসলি জমি ও তার শীর্ষস্তরের মাটি রক্ষায় নূ্যনতম ঔদাসীন্যের সুযোগ নেই। কৃষিপ্রধান একটি দেশে এমন প্রবণতা নিজের পায়ে কুড়াল মারারই নামান্তর। আমরা মনে করি, আত্মঘাতী এই প্রক্রিয়া অবিলম্বে এবং যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।

এটা ঠিক, কৃষক বা জমির মালিক এতে করে 'নগদ লাভ' দেখেন। কিন্তু সাময়িক লাভের জন্য স্থায়ী ক্ষতি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের সাময়িক ঋণ ও প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসতে পারে, যাতে করে কৃষককে ফসলি মাটি বিক্রি করতে না হয়। স্থানীয়ভাবে প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি জাতীয় কর্মপরিকল্পনাও জরুরি। কেবল জনসচেতনতামূলক কর্মসূচিতে কাজ হবে, এমন ভরসা করা কঠিন। আমাদের কৃষক ফসলি মাটি বিক্রির যে ফাঁদে পড়েছে, সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করতে হবে সামষ্টিক স্বার্থেই। কারণ উৎপাদন কমে গেলে আমাদের সামষ্টিক ভবিষ্যৎই পড়বে অনিশ্চয়তায়।

আরও পড়ুন

×