কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা
কর্মীর নিরাপত্তাই প্রথম

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২১ | ১৫:৪৭
বিগত তিন দশকে দেশে শিল্পকারখানা কয়েকগুণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। রোববার সমকালে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ সূত্রে বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক মিলে গত বছর ৭২৯ জন কর্মী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় প্রাণ হরিয়েছেন। আর ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এক হাজার ২০০ জন। এক বছরের তুলনামূলক বিশ্নেষণে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এটা স্পষ্ট যে, অবকাঠামো নিরাপত্তার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তায় আরও মনোযোগ বাড়ানোর বিষয়টি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত জরুরি।
আমরা জানি, উন্নত-অনুন্নত প্রায় সব দেশেই কর্মক্ষেত্রে কমবেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের দেশের পরিস্থিতি যে খানিকটা ভিন্ন তাও এড়ানোর অবকাশ নেই। কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎস্পর্শ, অগ্নিকাণ্ড, বয়লার বা সিলিন্ডার বিস্ম্ফোরণ, দেয়াল-ভবন-ছাদ-মাটিধস, ভবন থেকে পড়ে যাওয়া ইত্যাদিই মুখ্য। আমরা মনে করি, এসব ক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নেওয়া হলে বহুলাংশেই দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বীকৃত নীতি হলো- 'সেফটি ফার্স্ট' বা নিরাপত্তাই প্রথম। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাপত্তামূলক আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বিধায়ই আমাদের এমন মর্মন্তুদতার মুখোমুখি হতে হয়।
আবার এও সত্য, কর্মীদের দায়িত্বহীনতা কিংবা অসচেতনতার কারণেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার তাগিদ নানা মহল থেকেই বারবার দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তদারকির দায়-দায়িত্ব যাদের রয়েছে, তাদের উদাসীনতা কিংবা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগও কম নয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিংবা উন্নয়ন গতি যতই বাড়ছে, এর সঙ্গে কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ততই গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে। আমরা এও জানি, টেকসই উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে কোনোরকম শৈথিল্য মোটেও কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক উপকরণ সরবরাহ করা উচিত। একই সঙ্গে কর্মীদের সচেতনতা ও সরকারের সংশ্নিষ্ট মহলের নিবিড় তদারকিও সমভাবেই জরুরি। শিল্পকারখানা কিংবা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন অনুযায়ী নিরাপত্তার ব্যাপারে কর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের কথা বলা থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াটা দুঃখজনক। এটি কার্যকর হলে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে বলেই আমরা মনে করি। শ্রম আইনের নিয়মনীতির যথাযথ প্রয়োগ জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনেই বাঞ্ছনীয়।
আমরা আরও মনে করি, বাংলাদেশে শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মীদের শ্রেণিবিভাগ ও শিক্ষানবিশকাল যথাযথভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে একজন কর্মী পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে তার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেন। প্রচলিত বিধিবিধানের প্রয়োগে ঢিলেঢালা ভাব কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইনের আওতায় স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধানের যে নিয়ম রয়েছে, এর বাস্তবায়নের পাশাপাশি জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুঝুঁকি হ্রাসে শ্রম মন্ত্রণালয়সহ সংশ্নিষ্ট সব পক্ষ এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাক্রমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি বলে আমরা মনে করি। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের ক্ষেত্র যেহেতু ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে, সেহেতু কর্মপরিবেশ উন্নত না করার কোনোই বিকল্প নেই।
মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেও তা জরুরি। আমাদের সংবিধানে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সমতা ইত্যাদির কথা আছে। মানুষের অধিকারের সঙ্গে এই বিষয়গুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কর্মপরিবেশ নিরাপদ, আনন্দমুখর, নিস্কণ্টক করা শুধু কর্মীর জন্যই প্রয়োজন নয়- প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ-প্রসারের জন্যও তা অপরিহার্য। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত কারণে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দানের দ্রুত ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করতে হবে।