ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

আলোকিত পথিকৃৎ

আলোকিত পথিকৃৎ

মার্জিয়া লিপি

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২১ | ২২:২৩

মৃত্যু সম্পর্কে জ্ঞানতাত্ত্বিক সরদার ফজলুল করিমের কথা- 'মানুষের মৃত্যুদিন হচ্ছে তার সত্যিকারের জন্মদিন। কাজেই আমরা যে জন্মদিবস পালন করি কেউ পঞ্চাশে, কেউ চল্লিশে বা ষাটে- এটা খুব একটা যথার্থ নয়। কারণ তখনও পর্যন্ত পুরো পোর্ট্রেটটা আমাদের সামনে নেই। সার্কিটটা পূর্ণ হয়নি তখনও।' যথার্থই একজন মানুষের জীবৎকালকে সম্পূর্ণভাবে অনুসন্ধান করা যায় তার মৃত্যুর পরেই। বাংলাদেশের সাহিত্যের আলোকিত-আলোচিত বহুমাত্রিক সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের যে জীবনবৃত্তের শুরু ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বরে, তার সার্কিট পূর্ণ হয় ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি। তিনি জন্মেছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে মামার বাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি শ্রীনগর থানায়। বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ, মা হামিদা খাতুন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে আর দাদা ছিলেন শখের কবিরাজ। শৈশব-কৈশোর কেটেছে ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারের অলিগলির ভাড়া বাড়িতে।
রাবেয়া খাতুন বর্ণাঢ্য ও দীর্ঘ জীবনযাপন করেছেন। সাত দশকের বেশি সময় তিনি একাগ্র সাধনায় সাহিত্য রচনা করেছেন। বাংলা ভাষার খুব কম লেখকই এত দীর্ঘকাল সাহিত্য রচনার সুযোগ পেয়েছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনি- এসব কিছু মিলে বিশাল রচনাসমগ্র তার। কল্লোল-যুগোত্তর পূর্ব বাংলার 'নতুন সাহিত্য' আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রাবেয়া খাতুন। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম নারীদের জীবন যখন অনেক বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি, তেমনই সময় আত্মপ্রকাশ করেন তিনি একজন লেখক হিসেবে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় স্কুলের গণ্ডির পর তাকে কলেজে যেতে দেওয়া হয়নি। নিজেরও তেমন আগ্রহ না থাকায় এসএসসি পাস করার পর আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেননি।
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির জন্য রাবেয়া খাতুনকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। ১৯৪৮-৪৯ সাল। দু-চারটে গল্প ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিশোরী রাবেয়ার চোখে তখন স্বপ্ন লেখক হওয়ার। স্বপ্নটা যখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন হুট করে রাবেয়া খাতুনের বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি চিঠি আসে। চিঠিতে লেখা ছিল, 'রাবুর হাতের লেখা পত্রিকা অফিসের পরপুরুষেরা দেখে, এ জন্য আমাকে গঞ্জনা সহিতে হয়।' সে সময়ে মা-বাবার আপত্তি সত্ত্বেও রাবু একাগ্র সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সৃজনশীলতার পথে। সময়ের অতিক্রমণে সে দিনের সেই কিশোরী রাবু পরিণত হন বাংলাসাহিত্যের বহুমাত্রিক খ্যাতিমান সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনে। সম্মানিত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে।
১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই সম্পাদক ও চিত্র পরিচালক এটিএম ফজলুল হকের সঙ্গে বিয়ে হয় রাবেয়া খাতুনের। প্রথাগত পথে না হেঁটে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সে সময়ে সিনেমা পত্রিকার কাজ আর কথাসাহিত্যকে। তবে পরিণত বয়সে তিনি নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন একটি বলয়ে। অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন অনেক দূরের লেখক। এই প্রজন্মের অনেকেই তার লেখা বা নামের সঙ্গে পরিচিত হলেও সংস্পর্শে ছিলেন না। নন্দিত সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২০১২ সালে জুলাই মাসের এক অপরাহেপ্ত। গুলশানে তার আবাস 'গৃহকোণে'। 'কৃতিমান' নামে একটি প্রকাশনার জন্য তার সঙ্গে আলাপচারিতা হয়। সে সময়ে আলাপে জেনেছিলাম, জীবন ও সাহিত্যের নানান অনুষঙ্গ। বিনম্র প্রখর ব্যক্তিত্ব, নিচু কণ্ঠস্বর, ধীর পদক্ষেপ, ভরাট হাসিমুখের অবয়বকে দেখে ভাবাই যায় না, এই ব্যক্তিত্বের আড়ালে লুকিয়ে আছে বাংলা ভাষার অসম্ভব শক্তিমান লেখক সত্তা। পঞ্চাশের দশকের প্রায় অবরুদ্ধ বাঙালি মুসলমান সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রাবেয়া খাতুনের সাহিত্য নিয়ে সংগ্রাম এবং সাধারণভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম- এ দুই বিশেষ করে উল্লেখ্য। যে স্বপ্নময়তায় জীবনের শুরু করেছিলেন তা নিরবচ্ছিন্ন হয়নি। তরুণী অবস্থায় চারটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে একা পাড়ি দিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ-দীর্ঘতম পথ। সেই পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি শিক্ষকতা করেছেন। সম্পৃক্ত ছিলেন আরও অনেক কিছুতেই। তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির কাউন্সিল মেম্বার। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের বিচারক, শিশু একাডেমির কাউন্সিল মেম্বার।
রাবেয়া খাতুনের লেখার হাতেখড়ি হয় উপন্যাস দিয়ে। জীবনের অভিজ্ঞতার মতোই বৈচিত্র্যময় ছিল তার লেখার বিষয় ভাবনা। সমকালের রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, গণমানুষের ইতিহাস, মধ্যবিত্তের বিকাশ, জনপদ, প্রাকৃতিক গ্রামীণ জীবনের সমান্তরালে কৃত্রিম-নাগরিক যাপিত জীবন, দেশ ভাবনা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় ছিল তার কথাসাহিত্যের উপজীব্য। মধুমতী- প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনের দুঃখগাথা নিয়ে রচিত। পরবর্তী সময়ে 'মধুমতী' অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নির্মিত হয় অন্যান্য চলচ্চিত্র- 'কাঁচের দেয়াল', 'কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি', মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় উপন্যাস 'মেঘের পরে মেঘ'। সুদীর্ঘ সাত দশকে প্রকাশিত হয় ৪০০টি গল্প, ৫০টি উপন্যাস, ২০টির বেশি ভ্রমণসাহিত্য। উল্লেখ করার মতো শিশুসাহিত্য ও অন্যান্য লেখা। দেশ ভ্রমণ রাবেয়া খাতুনের অন্যতম নেশা ছিল। তীব্র অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তিনি ঘুরেছেন। ভ্রমণ শুধু ভালোই বাসতেন না, ভালোবাসতেন তার আনন্দ ও উপলব্ধিকে শব্দে প্রকাশ করতে। বাংলা ভাষার ভ্রমণ কাহিনি রচনার প্রথাবদ্ধ ছক তিনি ভেঙেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার অমর লেখা, নয় মাসের অবরুদ্ধ দিনের দিনলিপি- 'একাত্তরের নয় মাস', 'বধ্যভূমি'। শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয়, ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি লেখেন ফেরারী সূর্য, ঘাতক রাত্রি, হিরণ দাহ, বাগানের নাম মালনিছড়া ও হানিফের ঘোড়া। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তার লেখা অনূদিত হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকবেন সমকালীন বাংলাসাহিত্যে আলোকিত নক্ষত্র হয়ে। বিনম্র শ্রদ্ধা তাকে।
লেখক, গবেষক ও পরিবেশবিদ

আরও পড়ুন

×