ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

প্রতিবেশী

নতুন সেনা শাসনে পুরোনো মিয়ানমার

নতুন সেনা শাসনে পুরোনো মিয়ানমার

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১৬:০৭

মিয়ানমারে সেনা শাসন নতুন নয় এবং নতুন করে সামরিক অভ্যুত্থানে বিস্মিত হওয়ারও কিছু নেই। ১৯৬২ সাল থেকে টানা পঞ্চাশ বছরের সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্রের পথে যাত্রায় ২০১৫ সালে দেশটিতে প্রথম নির্বাচন হলেও তা সেনাবাহিনীর প্রভাবমুক্ত ছিল না। এমনকি গত বছরের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনও তার বাইরে নয়। তার পরও ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক'দিন ধরেই সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে একপ্রকার দ্বন্দ্ব আমরা দেখেছি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দিন আগে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য আরও ১২টি দেশ আলাদা আলাদা বিবৃতি দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে 'গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলা'র আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সব অগ্রাহ্য করে সোমবার ভোরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অং সান সু চি এবং সেখানকার জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

আমরা দেখেছি ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি-এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ৩২২টি আসনই যথেষ্ট, সেখানে দলটি বিস্ময়করভাবে ৩৪৬টি আসন পেয়েছে। আমরা দেখেছিলাম, এবারের নির্বাচনে সেখানকার তিন কোটি ৮০ লাখের মতো ভোটারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটের বাইরে রাখা হয়েছিল। এমনকি জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে যেখানে এনএলডির প্রভাব কম সেখানে ভোটের ব্যবস্থা করা হয়নি। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকেও ওই নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। তাদের মধ্যে অবিধারিতভাবেই বঞ্চিত ছিল রোহিঙ্গারা। যাহোক সে নির্বাচনের পর, সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে। সেই থেকে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে সোমবার নতুন পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার দিনই দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটল।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেখানে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটিই দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব অং সান সু চি ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকে আটকের তীব্র নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে সামরিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দও বিষয়টিতে নিন্দা জানিয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা চীনের কৌশলী মন্তব্য দেখেছি, 'মিয়ানমারে যা ঘটেছে তা লক্ষ্য করেছি আমরা, আর পরিস্থিতি আরও বোঝার প্রক্রিয়াতে রয়েছি। চীন মিয়ানমারের এক বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী। আমরা আশা করছি, মিয়ানমারের সব পক্ষ সংবিধান ও আইনি কাঠামোর অধীনে যথাযথভাবে তাদের পার্থক্যগুলো সামাল দিতে পারবে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।' এদিকে ভারত মিয়ানমারের অবস্থায় উদ্বেগ জানিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা বলেছে।

এখন মিয়নমারের নেত্রী অং সান সু চির গ্রেপ্তার নিয়ে আলোচনা চলছে। বস্তুত আন্তর্জাতিক বিশ্বে অং সান সু চির যে জনপ্রিয়তা ও ভালো অবস্থান দেখেছিলাম রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে আসার পরই সেটি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি সমালোচিত হন; বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক ডিগ্রি ও পদক প্রত্যাহার করে নেয়। মনে করা হয়, বার্মা- আজ যে দেশ মিয়ানমার নামে পরিচিত, সামরিকতন্ত্রের পথ থেকে বাঁক বদল করে গণতন্ত্রের দিকে নতুন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১০ সালের নভেম্বরে, কারণ সে বছরেই দীর্ঘ বন্দিত্ব শেষে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল অং সান সু চিকে। আমরা দেখছি, সেই সু চি আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের জবাব দিলেও, অপরাধ করা সত্ত্বেও তার দেশের সেনাবাহিনীকে 'রক্ষা'র চেষ্টা করলেও এখন সু চিরই রক্ষা হলো না। আমরা ভেবেছিলাম, আন্তর্জাতিক আদালতে তার উপস্থিতি ও বক্তব্য তাকে দেশের ভেতরে বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এখন সু চি দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও আন্তর্জাতিক সুনাম ও মিত্র তথা দু'কূলই হারিয়েছেন।

মিয়ানমারের সেনা শাসনে রোহিঙ্গা সংকট আরও গভীর হবে বলেই আমার মনে হয়। এমনিতেই সেখানকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও মিয়ানমারের সাবেক দুই সেনাসদস্য স্বীকার করেছেন, রোহিঙ্গা গণহত্যা, হত্যার পর গণকবর দেওয়া, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোয় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এবং ধর্ষণের যেসব অভিযোগ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উঠেছে, তার সবই সত্য। আর এখন স্বাভাবিকভাবেই এটি তাদের অগ্রাধিকারেও থাকার কথা নয়। ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে এসেছে, মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর দেশের কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে সেনাবাহিনী। নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নিয়ম অনুযায়ী ভোটার তালিকা তদন্ত ও পর্যালোচনা করা। কভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবিলা ও মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করা হবে; এবং জরুরি অবস্থা শেষে একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করবে। সেখানে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলেও এ অবস্থা কতদিন চলবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। যতদিন না আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে ততদিন এ অবস্থা সেনাবাহিনী বহাল রাখতে পারে। তবে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে পারে এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য দেশটি নানাভাবেও বৈশ্বিক চাপ দেখে আসছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। এমনিতেই মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে- এমনটি বলা যাবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা কয়েক বছর আগে আলোচনা করা হলেও তার কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি আমরা দেখিনি। যদিও সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এ মাসেরই প্রথম সপ্তাহে প্রত্যাবাসন নিয়ে নির্ধারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের এ অবস্থায় সে আলোচনার ভবিষ্যৎ কী- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ অবশ্য বলছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চলবে। এটা নির্ভর করছে, আমাদের সরকার মিয়ানমারের সেনাশাসনকে কীভাবে দেখছে, কীভাবে তাদের সঙ্গে কাজ করছে তার ওপর।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল 

আরও পড়ুন

×