জন্মদিন
তিনি যেভাবে আমাদের হলেন

মুনতাসীর মামুন
মোহাম্মদ বেলাল হোসেন
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ মে ২০২১ | ১৫:১০
ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বড় উৎস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক সময় তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, লড়াই করে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে 'অর্জন' করেছে। মুনতাসীর মামুন রবীন্দ্রনাথের সেই বাঙালি মানসে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম নিয়ে লিখেছেন 'রবীন্দ্রনাথ কীভাবে আমাদের হলেন'। আজকের দিনে আমরা দেখব অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কীভাবে আমাদের হলেন।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন দেশের বরেণ্য ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, চিন্তক ও প্রগতিশীল চেতনার বটবৃক্ষ। তিনি একাধারে কিশোর সাহিত্য রচয়িতা, ছোট গল্পকার, রাজনৈতিক ভাষ্যকার। মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাবিষয়ক গবেষক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার, শিল্প সমালোচক, শিল্প সংগ্রাহকসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য চর্চার মতো সৃজনশীল কাজেও তিনি নিয়োজিত। নানান প্রতিকূলতা যেমন মৃত্যুর হুমকি, মুরতাদ ঘোষণার পরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। গত চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কীর্তিমান শিক্ষক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু চেয়ারের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক। শিক্ষক হিসেবে লেখন, পঠন তার ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কলমযোদ্ধা হিসেবে রাজপথ থেকে কারাবরণ পর্যন্ত বহুমাত্রিক ভূমিকা তাকে এনে দিয়েছে জনসমাজে বিশিষ্টতার আসন।
অধ্যাপক মামুনের পুরো নাম মুনতাসীর উদ্দিন খান আল মামুন। জন্ম পুরান ঢাকার ইসলামপুরের আশেক লেনে নানার বাড়িতে ২৪ মে ১৯৫১ সালে। বাবা মিসবাহউদ্দিন খান, মা জাহানারা খান। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বাবার চাকরি সূত্রে ১৯৫৬ সালে মামুন চট্টগ্রামে আসেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৮৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
শহর ঢাকার ইতিহাস চর্চায় অধ্যাপক মামুন কাজ করেছেন তিন দশক ধরে। তিনি লিখেছেন ঢাকাবিষয়ক ২৭টি গ্রন্থ। 'ঢাকার স্মৃতি' নামে সম্পাদনা করেন ১৭টি গ্রন্থ। ঢাকার পরে অধ্যাপক মামুন গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেন পূর্ববঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশকে। লিখেছেন পূর্ববঙ্গ সমাজব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দলিল 'উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ'। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, নির্যাতন ও বধ্যভূমি নিয়ে গবেষণার কথা বলতে উঠে আসে অধ্যাপক মামুনের নাম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার হাত পড়েনি। সামরিক স্বৈরাচার সরকারের রোষানলে পড়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় পিছপা হননি। গণহত্যা ও বধ্যভূমি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অধ্যাপক মামুন খুলনার সাউথ সেন্ট্রাল রোডে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের একমাত্র গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘর। এই জাদুঘরের উদ্যোগে বর্তমানে দেশের প্রতিটি জেলায় বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ এবং নামফলক স্থাপনের কাজ চলছে। এই জাদুঘরের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ৪০টি বই।
মুনতাসীর মামুন বিশ্বাস করেন 'বিষয় যার যার ইতিহাস সবার'। এই বিশ্বাসকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী'। ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে এটি বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। তার প্রচেষ্টায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষাবর্ষের সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ইতিহাস চর্চা ও সৃজনশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ মুনতাসীর মামুনের পুরস্কার পাওয়া শুরু ছাত্রজীবন থেকে। ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া বঙ্গীয় সাহিত্য পুরস্কার, সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, ড. হিলালী স্বর্ণপদক, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার, অন্যান্য সাহিত্য পুরস্কার, বেণী মাধব স্মারক সম্মাননাসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি লাভ করেছেন।
আজ থেকে শতবর্ষ পরে কেউ যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থানের ইতিহাস পড়বে, বাঙালির অহমের ইতিহাস পড়বে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের গল্প শুনবে, সেখানে লেখক-গবেষকদের ফুটনোটে বারবার ফিরে আসবে মুনতাসীর মামুনের নাম। ৬৭তম জন্মদিনে তার প্রতি নিরন্তর শুভেচ্ছা ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
উপসচিব (প্রেষণে), মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম