সমকালীন প্রসঙ্গ
সত্য-সততার বিজয় প্রার্থনা

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১ | ১২:০০
এই উপমহাদেশের বরেণ্য ভাষাবিজ্ঞানী সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অমিয় এক বার্তা সর্বত্রই প্রচলিত। যে সমাজ গুণী ব্যক্তিদের মর্যাদাসীন করতে ব্যর্থ হয়, সে সমাজে গুণী ব্যক্তির জন্মও অসারতায় পর্যবসিত হয়। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক গুণগত শিক্ষার মুখ্য লক্ষ্য হচ্ছে দেশপ্রেমী অবাধ মুক্তচিন্তার পরিবেশ এবং জ্ঞান সৃজনের নান্দনিক ক্ষেত্র তৈরি করা। এর ব্যত্যয় হলে সাময়িক প্রসাধনী-অর্থনীতির চাকচিক্যকে অধিকতর দৃশ্যমান মনে হলেও কালান্তরে তা ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-জাতিরাষ্ট্রের কঠিন বিপর্যয়কে দীর্ঘায়িত করবে। সত্য-সততা-নৈতিকতা যাতে কোনোভাবেই অশুভ-অসত্য-অন্ধকারের শক্তির কাছে পরাভূত না হয়; সেদিকে পরিপূর্ণ মনোযোগ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিভাত হতে হবে। সমকালীন বাংলাদেশের সমাজে হত্যা-আত্মহত্যা-জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সমাজবিচ্যুত অপকর্মের পেছনে অর্থ-সন্ত্রাসের কদর্য সংযোগই যে দায়ী- এ সম্পর্কে কারও দ্বিমত করার সুযোগ নেই।
বিশ্বখ্যাত সুফিসম্রাট মওলানা জালালুদ্দিন রুমি প্রদত্ত অমিয় এক বক্তব্য স্মরণ করছি। তিনি বলেছিলেন, 'তুমি সাগরে একবিন্দু পানি নও। তুমি একবিন্দু পানিতে গোটা এক সাগর। শব্দ দিয়ে প্রতিবাদ করো, কণ্ঠ উঁচু করে নয়। মনে রাখবে ফুল ফোটে যত্নে, বজ্রপাতে নয়। গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম, তাই পৃথিবীটাকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি জ্ঞানী, তাই নিজেকে বদলে ফেলতে চাই।' দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মনুষ্যত্ব-মানবিক মূল্যবোধের চরম স্খলনের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যের সমাহারে প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে- অর্থ-সম্পদই সব নৈরাজ্যের স্রষ্টা। মওলানা রুমির উল্লিখিত মন্তব্য অনুধাবনে বিশ্বকে পাল্টানোর আগে নিজেকে পরিপূর্ণ আবিস্কার করার মধ্যেই প্রকৃত জ্ঞানের উন্মোচন। এটিও সত্য যে; ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, শুভ-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গল, আনন্দ-বিষাদ, আলো-অন্ধকারের ব্যবচ্ছেদ অনুসন্ধানে যারপরনাই আর্তনাদে কাতর-যন্ত্রণাদগ্ধ এই ধরিত্রীর প্রতিটি মানবিক মনন ও প্রকৃতির নিত্যানন্দ অনুষঙ্গ।
সামগ্রিক গুণাবলিতে আকাশচুম্বী মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো ব্যক্তিবর্গও শুধু অর্থ-সন্ত্রাসের কারণে সমাজে অতিশয় অপাঙ্ক্তেয়। কারও সম্পর্কে বিস্তারিত ও সম্যক জানার জন্য গভীর সম্পর্ক স্থাপন এবং তথ্য-উপাত্তের বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা নিতান্তই জরুরি। কর্ণাশ্রিত-প্রভাবিত প্ররোচনায় ব্যক্তিমানস নিরূপণ শুধু পাপ নয়; মহাপাপেরই অংশ বিশেষ। সমসাময়িককালে ব্যক্তিস্বার্থে সৎ ও সত্যবাদীদের বিরুদ্ধে নানামুখী কূট-চক্রান্ত বিপুল বিরাজিত। অনবদ্য-শাশ্বত মনুষ্যত্বের বিকাশকে রুদ্ধ করার হীন নিয়ামক হচ্ছে অবৈধ অর্থ-আধিপত্য-দৌরাত্ম্যের কুৎসিত আচরণ। স্বকীয় সত্তার দুর্বলতা-পাপাচার-কদাচার-নষ্টামি-অসভ্যতার হিংস্র প্রবৃত্তিকে লালন করে বিকৃত মনস্তাত্ত্বিক আত্মসন্তুষ্টিতে পরিপুষ্ট কতিপয় ব্যক্তির কারণেই পুরো জাতিরাষ্ট্র হচ্ছে কলুষিত। সংখ্যার দিক থেকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও গুটিকয়েক ব্যক্তির সমন্বয়ে অতিশয় ক্ষুদ্র সংখ্যালঘিষ্ঠদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিকারের সম্ভাব্য আলোয় তারা কখনোই উদ্ভাসিত হতে পারছে না।
আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাসের সঠিক অবিচ্ছেদ্য সত্য, ছলচাতুরী-অভিনয়শৈলী-তদবির-লবিং বাণিজ্য তথা অর্থ-সন্ত্রাসের ভব্য যোগফল অত্যন্ত সাময়িক এবং অন্তঃসারশূন্য। সুদূর-সদ্য অতীতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থ সংগ্রহ-আদায় ও পাচারের কুৎসিত দৃশ্য অবরুদ্ধ সততাকে শতভাগ নির্বাসনে পাঠিয়ে অসত্যকে জয়ী করার অসংযত ও অসংলগ্ন উপাদানগুলোকে বিশ্নেষণ অপরিহার্য গুরুত্ব বহন করে। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে বৈদেশিক সাহায্য, দাতাদের অনুদান, জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত বিপুল অঙ্কের অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তার যথার্থ সন্ধান এবং দেশবাসীকে অবহিত করার দাবি দীর্ঘদিনের। শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রাপ্ত আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা কোন ধরনের সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বরাবরে বরাদ্দ-ব্যবহার হয়েছে- এ সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশে নাগরিক সমাজের জোরালো কণ্ঠ অত্যন্ত উচ্চকিত। সুবিধাভোগী-আপসকামী-কথিত সস্তা জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার অতিমাত্রায় চাটুকার জ্ঞানপাপীদের ভূমিকা এক্ষেত্রে কতটুকু উৎসাহিত করছে, তাও খতিয়ে দেখা অনস্বীকার্য। নিকৃষ্টতম নির্লজ্জ এসব দুশ্চরিত্রের মানুষেরা ক্ষেত্রবিশেষে 'বিশিষ্ট'র মোড়কে দেশকে অনুন্নয়নের অভয়ারণ্যে রূপান্তরে ব্যতিব্যস্ত। অনৈতিক ও অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থের বিনিময়ে অত্যন্ত সুকৌশলে সংশ্নিষ্ট সবাইকে ম্যানেজ করে নানা অপকর্ম সম্পন্ন করে চলছে। জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-আগুন ও বোমাসন্ত্রাস-হত্যা-আত্মহত্যা-কিশোর অপরাধ-নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানান অরাজক-অসামাজিক-অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাজনীতির বিকৃত পরিচর্যায় দেশকে অস্থিতিশীল করার পেছনে রয়েছে এই অর্থ-সন্ত্রাসের সুপরিকল্পিত কুকর্ম ও কুকীর্তি।
প্রাচুর্য-বিলাস-ভোগবাদের বিপরীতে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অপুষ্টি-অসুস্থতা-দুর্ভোগ নিরন্তর তৈরি করেছে মানবসৃষ্ট দুর্বোধ্য বৈষম্যের পরিধি ও বিস্তৃতি। স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে নির্মিত হয়েছে কথিত ব্যক্তি খাতে ঘৃণ্য চাতুর্যে শিল্পায়ন-ঋণখেলাপি-অর্থ পাচার-অপরাজনীতির অপসংস্কৃতি। সেনা শাসকদের স্বৈরশাসন বিশ্নেষণে দেখা যায়, প্রাক-'৭৪ পর্বে ব্যক্তি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১২ কোটি টাকা। ১৯৭৫-৮১ সালে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭৬ কোটি টাকায়। ওই সময়ে ঋণ গ্রহণকারী চার হাজার শিল্প প্রকল্পের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ১৯৮২ সালের পরবর্তী ৯ বছরে শিল্প খাতে ঋণ বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকার অধিক। অনুমোদিত এই শিল্পঋণের সত্তর শতাংশ কোথাও বিনিয়োগ হয়নি। পুঁজি বিনিয়োগ বোর্ডের জরিপ থেকে জানা যায়, '৮৫-৯০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে গড়ে সাত হাজার ৫৩১টি অনুমোদিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে চার হাজার ৪২২টির কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
অতীতে দুর্বৃত্তায়নের মহোৎসবে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের মতোই ক্ষমতা সংশ্নিষ্ট দুর্নীতিবাজদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না করে অতি সমাদর পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ ধ্বংসের সব প্রচেষ্টাই প্রণোদিত হয়েছে। মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গি-সন্ত্রাস-দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার কারণে অদম্য অগ্রগতিতে দেশ এগিয়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে প্রোদ্ভিন্ন উন্নয়নের প্রশংসিত অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। তারই সুনিপুণ নেতৃত্বে বিগত দশকে গণমাধ্যমের অবাধ তথ্যপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনসহ প্রতিবেদন-নিবন্ধের সমাহার দেশবাসীকে সামগ্রিক বিষয়ে অবহিত করার লক্ষ্যে উপাত্ত-পরিসংখ্যানের তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ ছিল প্রমুদিত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটি প্রতিষ্ঠিত অর্থ-সন্ত্রাসের এই বিস্তৃতি শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। অকল্পনীয় দুষ্টপন্থা অবলম্বনে দেশ থেকে অপরিমেয় অর্থ পাচার করে দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সংবিধান ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুমহান মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করার দুঃসাহস দেখাতেও পিছপা হচ্ছে না। অর্থ পাচারের অস্বাভাবিক চিত্র পর্যবেক্ষণে বিষয়গুলো অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর জার্মানির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টার 'ডিডব্লিউ'র প্রতিবেদন অনুসারে বিগত ১০ বছরে দেশের দুটি বাজেটের সমপরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে শীর্ষে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির' (জিএফআই) ২ মের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে ৯১১ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। ওই সূত্রে জানা যায়, মূলত এই অর্থ পাচারের যোগসূত্র রচিত হয়েছে আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে। সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫-১৪ সময়কালে অর্থ পাচারের পরিমাণ সাত হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যার দেশীয় মুদ্রামান ছয় লাখ ছয় হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'এসএনবি'র ২০১৫ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই দেশের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থ আমানতের পরিমাণ প্রায় চার হাজার ৪০৮ কোটি টাকার বেশি। অতীতে 'পানামা পেপারস'-এ প্রকাশ পেয়েছিল, বাংলাদেশের অন্তত ৫০ ব্যক্তি ও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে অফশোর কোম্পানি স্থাপন করেছে। 'ডিডব্লিউ'র প্রতিবেদন মতে, কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম আর সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে আট হাজার কোটি টাকার সম্পদ-জামানত দেশবাসীকে চরম হতবাক করেছে। কানাডায় অর্থ পাচারকারী ২৮ জনের তালিকায় ২৪ জনই সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর বাকি চারজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ।
সমগ্র দেশবাসীর মতো আমিও আস্থার সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই- বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে গৃহীত উদ্যোগগুলোর অন্যতম বিদেশে অর্থ পাচারের ভয়াবহতা নিধনে বাংলাদেশ বিজয়ী হবেই। মহান স্রষ্টার কৃপায় সব ক্ষেত্রে সত্য-সততার বিজয় ঘোষিত হোক। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের 'সত্য-কবি' উচ্চারণে অসত্য-অন্যায়-অবিচার-কদাচার নির্বাণ-ব্রতে আমাদের কণ্ঠে যেন উচ্চারিত না হয় 'অসত্য যত রহিল পড়িয়া, সত্য সে গেল চ'লে/বীরের মতন মরণ-কারারে চরণের তলে দ'লে।/যে-ভোরের তারা অরুণ-রবির উদয়-তোরণ-দোরে/ঘোষিল বিজয়-কিরণ-শঙ্খ-আরাব প্রথম ভোরে,/ রবির ললাট চুম্বিল যার প্রথম রশ্মি-টীকা,/বাদলের বায়ে নিভে গেল হায় দীপ্ত তাহারি শিখা!/মধ্য গগনে স্তব্ধ নিশীথ, বিশ্ব চেতন-হারা,/নিবিড় তিমির, আকাশ ভাঙিয়া ঝরিছে আকুল-ধারা,/গ্রহ শশী তারা কেউ জেগে নাই, নিভে গেছে সব বাতি,/হাঁক দিয়া ফেরে ঝড়-তুফানের উতরোল মাতামাতি!' এমন প্রত্যাশাই পোষণ করি।
সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়