ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আশি পেরিয়েও দেদীপ্যমান

আশি পেরিয়েও দেদীপ্যমান

রামেন্দু মজুমদার

মলয় ভৌমিক

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০২১ | ১৫:০৪

জাতীয় সংকটকালে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া বা অতিদ্রুত নিজেকে শামুকের মতো খোলসের মধ্যে গুটিয়ে ফেলা যখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত-চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন এই স্রোতের বিপরীতে যে ক'জন মানুষকে এখনও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে দেখি, রামেন্দু মজুমদার তাদের মধ্যে অন্যতম।

স্বাধীনতার পরে ঢাকাসহ সারাদেশে ধারাবাহিকভাবে আধুনিক নাট্যচর্চা শুরু হয়। বাংলাদেশে নবনাট্যের এই আন্দোলনে যে ক'জন মানুষ নেতৃত্ব দিয়েছেন, রামেন্দুদা ছিলেন তাদের সম্মুখ কাতারের সৈনিক। নিজের নাট্যদল 'থিয়েটার'কে দেশের প্রথম সারির দল হিসেবে এখন পর্যন্ত ধরে রাখা, পাশাপাশি তার সম্পাদনায় দেশের প্রথম নাট্য ত্রৈমাসিক 'থিয়েটার'-এর প্রকাশনার ধারাবাহিকতা রক্ষা রামেন্দুদার মতো মানুষের পক্ষেই সম্ভব। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন জাগে, অলাভজনক অথচ অতি প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন এই পত্রিকাটি তিনি কোন জাদুবলে এত দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রেখেছেন?

পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যখন স্বাধীন বাংলাদেশের সব শুভ চেতনাকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শবাদী প্রেতাত্মাদের থাবার নিচে ফেলা হলো, তখন সেই অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হাতে যারা সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন, রামেন্দুদা তাদের মধ্যে ছিলেন নেতৃস্থানীয়। সেই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইয়ে অনেকে মাঠ থেকে সরে গেলেও দাদার শৈল্পিক লড়াই এখনও উচ্চকিত।

বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অন্য অনেকের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এবং রামেন্দুদাকে কী পরিমাণ অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তা সবাই জানেন। চরম নিরাপত্তাহীনতার সেই সময়ে আমরা দু'জনকেই 'অনুশীলন' নাট্যদলের এক অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীতিকর অবস্থার তোয়াক্কা না করে রামেন্দুদা ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আমাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। বিএনপি-জামায়াত সরকারের নানা অপকর্মসহ স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের সেদিনের বক্তৃতাও ছিল ক্ষুরধার।

ভদ্র, বিনয়ী, শান্ত স্বভাবের রামেন্দুদা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই বুকের ভেতর তার কত সাহস। ওয়ান ইলেভেনের সময় আমরা জেলখানায় বন্দি ছিলাম। ইচ্ছা থাকলেও অনেকে আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভয়ে যোগাযোগ করতে পারেননি। আমাদের স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের জন্য সে এক চরম দুঃসহ সময়। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে ক'জন সেদিন আমাদের পরিবারের সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের সাহস জুগিয়েছিলেন, রামেন্দুদা তাদের অন্যতম।

রামেন্দুদা বাংলাদেশের নাটককে বিশ্বের নাট্যবোদ্ধাদের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন। কেবল পেশাদার নাট্যজনেরাই ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সদস্য হতে পারেন। নাট্যজনদের নাটকের প্রতি নিষ্ঠা ও ভালোবাসাই যে বাংলাদেশের নাটকের পেশাদারিত্ব, এ কথাটা দাদা প্রায় একক চেষ্টায় বিশ্ব-নাট্যব্যক্তিত্বদের বোঝাতে সক্ষম হন। এরপর বাংলাদেশে আইটিআই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় আর কোনো বাধা থাকে না। রামেন্দুদা তার নিষ্ঠা ও ব্যক্তিত্বের গুণে দু'বার আইটিআইর বিশ্বসভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের জন্য এ এক বিরল গৌরব।

সবাই জানেন রামেন্দুদা মঞ্চের মানুষ। কিন্তু মঞ্চের অভিনয়ে তাকে কমই দেখা যায়। তিনি দক্ষ নির্দেশক হওয়া সত্ত্বেও হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি নাটকে নির্দেশনা দিয়েছেন। যদি তিনি নিয়মিত অভিনয় করতেন ও নির্দেশনা দিতেন, তাহলে দেশ হয়তো নামকরা অভিনেতা পেত, সুদক্ষ নাট্যনির্দেশক পেত; কিন্তু আজকের সমৃদ্ধ থিয়েটার থেকে বঞ্চিত হতো। থিয়েটার দাঁড়িয়ে না গেলে আজকের অভিনেতা-নির্দেশক তৈরি হতো না। রামেন্দুদারা থিয়েটারকে দাঁড় করিয়েছেন বলেই আজ অনেকে নামিদামি অভিনেতা-নির্দেশক হচ্ছেন। তার মতো ব্যক্তিদের বিপুল ত্যাগ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া এদেশে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন গড়ে উঠত না, সূচনা হতো না প্রাতিষ্ঠানিক নাট্যশিক্ষার, আলোর মুখ দেখত না নাট্যবিষয়ক পত্রিকা, গড়ে উঠত না দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সর্বোপরি আমাদের নাট্যের প্রশংসনীয় আন্তর্জাতিক যাত্রাও সম্ভব হতো না তাকে ছাড়া।

রামেন্দু মজুমদার আমাদের পথিকৃৎ, মাথার ওপরে বটবৃক্ষের মতো ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশাল প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হলে মাথা নিচু করেই প্রবেশ করতে হয়। আজ তিনি আশি পেরিয়ে একাশি বছরে পা রাখলেন। গত দশ বছরে শিল্পকলা একাডেমি পরিষদে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে তিনি এখনও আমাদের সবার কাছে সক্রিয় ও দীপ্যমান এক অভিভাবক। জন্মদিনে তার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা! তিনি আরও দীর্ঘদিন দীপ্যমান থাকুন এই কামনা করি!

নাট্যকার ও শিক্ষাবিদ

আরও পড়ুন

×