সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ নুরুল হুদা
পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধই সবচেয়ে বড় সংস্কার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: দেবব্রত চক্রবর্তী বিষুষ্ণ
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২২ | ১৪:৩৭
মুহাম্মদ নুরুল হুদা বাংলাদেশ পুলিশের ১৭তম মহাপরিদর্শক হিসেবে ২০০০ সালের ৭ জুন থেকে ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অবসর জীবনে যুক্ত হন লেখালেখির সঙ্গে। দেশের বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখছেন। মুহাম্মদ নুরুল হুদা খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন।
সমকাল: সম্প্রতি ঢাকার শাহজাহানপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে স্থানীয় এক রাজনীতিক ও রিকশারোহী শিক্ষার্থী; মিরপুরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে চিকিৎসক নিহতসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এমন ঘটনা আরও ঘটেছে। অনেকেরই অভিযোগ, জননিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে। সাবেক পুলিশপ্রধান হিসেবে এ সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা: জননিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে- এ কথার সঙ্গে আমি একমত নই। পরিস্থিতি বিশ্নেষণে হয়তো দেখা যাবে, যে সময়ে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর সঙ্গে অতীতের চিত্র মেলালে বা তুলনামূলক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে খুব একটা পার্থক্য দেখা যাবে বলে মনে হয় না। সামাজিক অপরাধ হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সমাজের সমকালীন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা থাকে। তবে এ ধরনের ঘটনা উদ্বেগের ব্যাপার তো বটেই। পাশাপাশি এ কথাও আমলে রাখা প্রয়োজন, বিশ্বের দেশে দেশে এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জনসংখ্যার অনুপাতে সমাজে যে অপরাধচিত্র দৃশ্যমান, তাতে আমাদের পরিস্থিতি ততটা খারাপ বলে মনে হয় না। তারপরও বলব, এমন ঘটনা যাতে ফের না ঘটে সে রকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেসব ঘটনা ঘটেছে এর তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া অবশ্যই জরুরি। পুলিশ দ্রুত চার্জশিট দিয়ে অপরাধের হোতাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করবে- এটাই প্রত্যাশিত।
সমকাল: শাহজাহানপুরে নিহত শিক্ষার্থীর বাবা বলেছেন, তিনি তার সন্তান হত্যার বিচার চান না। এমন বক্তব্য কি শুধুই ক্ষোভ বা হতাশার বহিঃপ্রকাশ, নাকি বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা?
নুরুল হুদা: এ ধরনের ঘটনার শিকার যারা হয়েছেন তাদের পরিবার বা স্বজনদের বেদনার প্রতিক্রিয়া নানাভাবেই প্রকাশ পেতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। সন্তানহারা ওই বাবা তো সত্যই বলেছেন- তার মেয়ে তো ফিরে আসবে না। তিনি হয়তো এও বুঝতে পেরেছেন, তার সন্তান ঘাতকদের টার্গেট ছিল না। বলা যায়, আংশিকভাবে এটি একটি দুর্ঘটনা। তা ছাড়া মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলায় ভুক্তভোগীর বিড়ম্বনার বিষয়গুলো তো আমাদের অজানা নয়। সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্র এ ব্যাপারে খরচপাতিও বহন করে না। আমাদের দেশে এমন সামাজিক সংগঠনের সংখ্যাও হাতে গোনা, যারা ভিকটিমের সহায়তায় হাত বাড়ায়। যারা নানাভাবে দুর্বল, সামর্থ্যহীন তাদের পক্ষে অপরাধের বিচারের দাবিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো বা মামলা-মোকদ্দমা চালানোর সক্ষমতা নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভুক্তভোগী বা ঘটনার শিকার যে বা যারা; তাদের অনেকে বেদনা বুকে নিয়েই বসে থাকেন। তবে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে যূথবদ্ধ প্রয়াসে।
সমকাল: অপরাধ প্রতিরোধে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশ কি ব্যর্থ?
নুরুল হুদা: শুধু পুলিশের ব্যর্থতা দেখলেই চলবে না। পুলিশ জনকল্যাণমূলক কাজও কম করেনি বা করছে না। ফৌজদারি অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্ত করে বিচারের পথ মসৃণ করা পুলিশের গুরুদায়িত্ব। পুলিশ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও সংস্থা রয়েছে দায়িত্বরত। সবারই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার প্রমাণ রাখতে হবে। বিভিন্ন কারণে অপরাধ সংঘটিত হয়। নজর দিতে হবে কারণগুলোর দিকে। আগেই বলেছি, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও অনেক কারণের সৃষ্টি হয়, যেগুলোর সবই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বাহিনী বা সংস্থার ব্যর্থতা এভাবে নির্ণয় করা সমীচীন মনে করি না।
সমকাল: পুলিশের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ নেই- এ অভিযোগও নতুন নয়।
নুরুল হুদা: আমি মনে করি, ব্যক্তিবিশেষের ব্যর্থতার দায় গোটা বাহিনী বা সংস্থার ওপর চাপানো ঠিক নয়। ব্যক্তিগতভাবে যদি কারও বিচ্যুতি ঘটে থাকে; এর প্রতিকার অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এর অংশীজন সবাই নন- এও তো সত্য। আমাদের আইনে পরিস্কারভাবেই উল্লেখ আছে কীভাবে দায়িত্ব পালন বা কাজ করতে হবে। কার্যবিধিতে উল্লেখ আছে, আইন মেনে নীতিনিষ্ঠ থেকে কাজ করতে হবে। কেউ যদি এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয়ভাবে কিংবা সরকারও আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রতিষ্ঠানের নীতিমালায় বলা নেই- ব্যক্তি বা মহলবিশেষকে তুষ্ট করে দায়িত্ব পালন করো। ব্যক্তি ও ক্ষেত্রবিশেষে যদি এমন অভিযোগ ওঠে, তাহলে যথাযথ প্রতিকার করতে হবে।
সমকাল: পুলিশের সেবা নিতে গিয়ে অনেকেই হেনস্তা কিংবা বিড়ম্বনার শিকার হন। অবস্থা যদি এ-ই হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের গত্যন্তর কী?
নুরুল হুদা: এমন যদি কেউ করে থাকেন, নিশ্চয় তা গর্হিত। দেশের সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অবকাশ আছে এবং নেওয়া অবশ্যই দরকার বলে মনে করি। সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির ব্যত্যয় ঘটানোর কোনোই অবকাশ নেই। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ার বিকল্প নেই। এমনটি যদি বড় আকারে ঘটার প্রমাণ মেলে, তাহলে আদালতের সাহায্য নিতে হবে। নির্বাহী বিভাগের কাছেও প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে।
সমকাল: আপনি অতীতে বলেছিলেন, পুলিশকে যদি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয় তাহলে তা রাজনৈতিক দৈন্য। প্রশ্ন হচ্ছে- কীভাবে এই দৈন্য ঘোচানো যায়?
নুরুল হুদা: রাজনীতিকরা জনগণের খুব কাছের মানুষ। তারা জনগণের অনুভূতি সরাসরি আঁচ করার সুযোগ অনেক বেশি পান। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা তাদের সংগঠনের আদর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন; জনকল্যাণে ভূমিকা রাখবেন এবং তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। তাদের কাজে পুলিশ বা অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্পৃক্ত করা কিংবা তাদের প্রভাবিত করার প্রশ্নই আসে না। সরকার সবার, কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শের অনুসারী সবাই হবেন- তা অমূলক ভাবনা। পুলিশের রাজনীতিকরণের দায় রাজনীতিকদের।
সমকাল: প্রযুক্তি অনেক কিছুই সহজ করে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- পুলিশ প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের পেশাগত দক্ষতা কতটা অর্জন করতে বা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে?
নুরুল হুদা: কিছু ক্ষেত্রে তো উন্নতি-অগ্রগতি আছেই। প্রযুক্তির কল্যাণে শুধু পুলিশের নয়; আরও অনেক স্তরেই কাজে গতিসঞ্চার হয়েছে। নতুন কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। তদন্ত, অপরাধের সূত্র-উৎস সন্ধান, রেকর্ড সংরক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বিকাশের ছোঁয়া পুলিশের কাজে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মানুষের সেবাপ্রাপ্তির পথও অনেক সহজ হয়েছে। আমরা তো একসঙ্গে সব প্রত্যাশা পূরণের আশা করতে পারি না। করাটা স্বাভাবিকও নয়। এ সবই চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মানোন্নয়নসহ সার্বিক বিকাশের পথ আরও প্রশস্ত হবে- এ প্রত্যাশা রাখি।
সমকাল: আপনি কি মনে করেন, পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার বা বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন?
নুরুল হুদা: হ্যাঁ, এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করি না। তবে এও চলমান প্রক্রিয়াভুক্ত রাখতে হবে আরও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ভিত্তিতে। চাকরিবিধি, অনুশাসন ইত্যাদির প্রতি নিষ্ঠ থাকলে এর ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে দৃশ্যমান হবে। এসব বিষয় কার্যকর করার লক্ষ্যে অনেক পরামর্শ এর আগে দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভাগগুলোর এসব ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব রয়েছে আইনপ্রণেতা এবং রাজনীতিকদেরও। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে- এটাই সবচেয়ে বড় সংস্কার হতে পারে। পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধই সবচেয়ে বড় সংস্কার।
সমকাল: পুলিশকে আরও বেশি জনবান্ধব করার ব্যাপারে আপনার কোনো প্রস্তাব আছে কি?
নুরুল হুদা: সংবিধানে যা বলা আছে, এর প্রতিপালন-অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা দায়িত্বশীল কেউই যেন ভুলে না যান। ফৌজদারি কার্যবিধিতেও যা বলা আছে সেসবই পুলিশের পেশাগত দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই। যার যে কাজ নির্দিষ্ট তা ঠিকমতো করলেই জনগণ সুফলভোগী হবে। প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও ক্রমে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।
সমকাল : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নুরুল হুদা: ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।