ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

মতামত

গণতন্ত্রের চাবি ফিরিয়ে দিন

গণতন্ত্রের চাবি ফিরিয়ে দিন

রহমান মৃধা

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২ | ০৮:০৮ | আপডেট: ১৫ মে ২০২২ | ০৮:৪৩

দেশের বাইরে থাকলেও দেশের নানা সমস্যা প্রতিনিয়ত আমার চোখে পড়ে। ওইসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আগে খুঁজি সমস্যার কারণগুলো। একটি সমস্যার সঙ্গে আরেকটির সংযোগ রয়েছে। যেমন দুর্নীতির পেছনে রয়েছে শিক্ষার অবনতি। বন্দুকযুদ্ধ বা খুন-খারাবির পেছনে বিবেকের অবক্ষয় এবং অভাব-অনটন জড়িত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ন্যায়বিচারের অভাব বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে এসব সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী।

ওপরের সমস্যাগুলো শুধু যে বাংলাদেশে তা নয়; এ ধরনের সমস্যা কমবেশি সব দেশে লক্ষণীয়। এর মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশ এবং আফ্রিকার অনেক দেশ উল্লেখযোগ্য। যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল দেখেছি তার মধ্যে একটি জিনিস বেশ পরিস্কারভাবে লক্ষণীয়- জাতীয় জীবনে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। এখন প্রশ্ন, সামাজিক নিরাপত্তা কী এবং তা কীভাবে পাওয়া যেতে পারে? যেসব দেশে সামাজিক নিরাপত্তা রয়েছে তার স্বরূপ কেমন? সামাজিক নিরাপত্তা মানে জাতির নূ্যনতম একটি আয়ের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শিশু পুষ্টির ব্যবস্থা, বেকার ভাতা, ছেলেমেয়ের স্কুলের ব্যবস্থা, বৃদ্ধের ভাতা, শান্তি এবং স্বস্তিতে বসবাস করা, বলতে গেলে কমবেশি সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

যেসব দেশে নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন- নিকটতম দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া। যেসব দেশে উচ্চতম সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন- সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড। আবার যেসব দেশে বলতে গেলে এর কিছুই নেই, যেমন- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ এর মধ্যে পড়ে।

আবার যেমন অপরাধ কমবেশি পৃথিবীর সব জায়গায় রয়েছে; তবে বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে দিনে দুপুরে মানুষ খুন, বন্দুকযুদ্ধের নামে সত্যকে ঢাকতে খুন, দুর্নীতি, প্রশিক্ষণের অধঃপতন, চিকিৎসায় ফাঁকি, খাবারে ভেজাল এবং গুম, এর মূল কারণ একটাই তা হলো এসব দেশের মানুষের জীবনে সামাজিক নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। আর নেই বলেই সবাই লুটপাট থেকে শুরু করে যত ধরনের অপকর্ম করা যায় তা করছে।

ধর্মীয় কথা, জেলহাজতের ভয় দেখিয়ে এমনকি বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করেও কোনো পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা ভুল হবে। জাতির অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং সর্বোপরি তাঁদের বাকশক্তির স্বাধীনতার নিরাপত্তা দিতে না পারলে দেশের সমস্যার পরিবর্তন হবে না। মুখে মুখে বললে হবে না- জনগণ ক্ষমতার মালিক, হাতেনাতে প্রমাণ করে দেখাতে হবে।

বাংলাদেশের পরিবর্তন আনতে হলে জনগণের ভালোবাসা, বিশ্বাস যদি সরকার অর্জন করতে না পারে তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তা, দুর্নীতিমুক্ত, খুন-খারাবি, কুশিক্ষা এর কিছুরই পরিবর্তন হবে না। মানুষের কাছে গণতন্ত্রের চাবি ফিরিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে সম্মানের সঙ্গে তাঁদের সামাজিক মৌলিক অধিকার এবং তাঁরাই যে মাস্টার অব দ্য আর্ট তা প্রমাণ করে দেখাতে হবে। তাহলে সম্ভব বাংলার মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।

আমরা কি প্রস্তুত এমন একটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে? আমি সুইডেনে থাকি, দেখছি এখানে কীভাবে বেকার ভাতা দিয়ে বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করছে। এখানে যদি কেউ লেখাপড়া করতে চায় তাঁকে সে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এখানে ভেজাল খাদ্যের কোনো উৎস নেই। এখানে দুর্নীতির জায়গা নেই। এখানে গণতন্ত্রের বেস্ট প্রাক্টিস হচ্ছে প্রতিক্ষণ। সরকার দায়বদ্ধ তাঁর মাস্টারের কাছে জবাবদিহি করতে এবং করছে। পুরো প্রশাসন জনগোষ্ঠীর জন্য ২৪ ঘণ্টাই তাঁদের সেবায় নিয়োজিত।

ধর্ষণ, দুর্নীতি, মানুষে মানুষ খুন, নীতিতে দুর্নীতি ঢোকানো, খাবারে ভেজাল মেশানো এসব হয়েছে বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ জনগণের কাজ। জনগণকে তাঁর ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে এবং প্রশাসনকে জনগণের পাশাপাশি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেশকে সুইডেন বা নিউজিল্যান্ড করার স্বপ্ন দেখতে হবে এবং তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। প্রথম যে কাজ করতে হবে তা হলো সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। তবে শুরু করতে গেলে নতুন ধরনের বাধা আসতে পারে। তাই একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, সেই একাত্তরের রক্তের দাগ এখনও আমার মতো অনেকের হাতে লেগে আছে এবং সেটা তাঁরা কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। সেই রক্তের দাগ দুই ধরনের মানুষের মধ্যে এখনও বিরাজ করছে। যারা বাংলাদেশ চেয়েছিল এবং রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করে গেছে; আর যারা বাংলাদেশ চায়নি, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, লেখকের হাত কেটেছে, মানুষের চোখ তুলে নিয়েছে, মানুষের বুক চিরে হূৎপিণ্ড বের করে নিয়েছে। তারা এবং তাদের বংশধর এখনও বেঁচে আছে। এত বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু তারা একবারও নিজেদের দোষ স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি। একাত্তরের ঘটনা আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের কাছে পুরোনো ঘটনা নয়; একাত্তরের ঘটনা আমাদের শরীরের রক্তক্ষরণ। আমি অনেক কিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করি, কিন্তু এই একটি ব্যাপার আমি কখনও ভুলিনি।

সবকিছু জেনে শুনে, নতুন করে একত্র হয়ে, দেশের স্বার্থে, অতীতের কথা ভুলে, আর পুরোনো স্মৃতি মনে রেখে, সম্ভব হবে কি আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দেশ গড়ার কাজে! আমি বিশ্বাস করি- সম্ভব হবে। দেখুন ফিনল্যান্ডকে, অল্প বয়সের নতুন প্রজন্মের একটি মেয়ে, প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন নতুন করে ভাবছেন তাঁর দেশকে নিয়ে। তিনি স্যুট পরে নয় জ্যাকেট পরে নিউ লুক, নিউ ইমেজ নিয়ে নেমেছেন পরিবর্তনের জন্য।

আরও পড়ুন

×