ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অর্থনীতি

বাজার নিয়ে সময়ে এক ফোঁড় দিন

বাজার নিয়ে সময়ে এক ফোঁড় দিন

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২২ | ১২:০০

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী শুধু নয়; স্বল্প আয়ের তথা নিম্নবিত্তরাও কষ্টে রয়েছে। এটা ঠিক, স্বল্প আয়ের এক কোটি মানুষকে টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে শুরু করেছিল সরকার; কিন্তু সেটিও এখন বন্ধ। যদিও ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের কথা রয়েছে। আমি বলব, সেজন্য খোলাবাজারে ট্রাকসেল বন্ধ করার যুক্তি নেই; বরং ওএমএস কার্যক্রমটি দ্রুত চালু করা উচিত। খোলাবাজারে বরং আরও বেশিসংখ্যক পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজের পাশাপাশি অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় বিক্রি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের তালিকা সংগ্রহে বিভিন্ন ডাটাবেজ থেকে তথ্য নিতে পারে।
আমরা জানি, এ মাসেই জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় আরও বেশি মানুষকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা উচিত। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের হিসাব করলে সংখ্যা হিসেবে এক কোটি যথেষ্ট নয়। তাই বাজেটে আরও বেশি নিম্নবিত্তকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে আনতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ানো দরকার। যেটা এখন আড়াই লাখ টাকা আছে, এটাকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে বছরে দু'বার বাজার উত্তাপ ছড়াতে পারে বৈকি- রমজান ও বাজেট ঘোষণার মাসে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে প্রায় সারা বছরই সব পণ্যেরই দাম বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে দেখলাম বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি। এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়টি মুখ্য নয়। যেটি জরুরি তা হলো বাজারে তদারকি বাড়ানো, যাতে ব্যবসায়ীরা পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে বিশ্ববাজার থেকে আমদানি খরচ বাড়বে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম সামান্য কমলেও ডলারের দাম বাড়ায় বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে সরকার গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফলসহ বিলাসবহুল পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে এসব পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত কর আরোপ করেছে। আমি মনে করি, এটি সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত কর বা শুল্ক্ক আরোপ করা হয় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে। তাই চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, গম, ভুট্টা, ভোজ্যতেল আমদানিতে অতিরিক্ত কর আরোপ করা যাবে না।


মনে রাখতে হবে, করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে। যখন সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছিল, তখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া রয়েছে খাদ্যপণ্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি বিরাজ করছে। আইএলওর তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ মাসে মূল্যস্ম্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ, তার আগের মাসে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। তার মানে, মূল্যস্ম্ফীতি প্রায় তিন গুণ। দুর্ভাগ্যজনক হলো, সরকারি হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক আরও বেশি। সরকারি পরিসংখ্যানে মূল্যস্ম্ফীতি সিঙ্গেল ডিজিটে থাকলেও গবেষকদের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, এটি ডাবল ডিজিটে প্রবেশ করেছে।
আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান যখন দিন দিন বাড়তে থাকে, তখন মানুষ বিভিন্নভাবে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। দীর্ঘমেয়াদি এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং আয় না বাড়লে তখন অনেকে সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালান। এটা সবাই পারেন না; যাদের সঞ্চয় থাকে তাঁরা এটা করে সাময়িক পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। এভাবে সঞ্চয় ভেঙে খেতে থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতেও পড়ে। সঞ্চয় কমে যাওয়ার চিত্র সরকারের পরিসংখ্যানেও দেখা যায়। যাঁদের সঞ্চয় নেই বা সঞ্চয় শেষ হয়ে যায় তাঁরা ধার বা ঋণ করে চলেন। যখন সেই পথও বন্ধ হয়ে যায়, তখন বেঁচে থাকার যুদ্ধে নামেন। পুষ্টিকর খাবার থেকে সরে আসেন। ফলে এসব মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগেন। আক্রান্ত হতে থাকেন নানা ধরনের রোগ ব্যাধিতে। দেখা যাচ্ছে আগে যাঁরা সপ্তাহে ৩ দিন আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য বিকল্প হিসেবে ডিম খেতেন, তাঁরা ডিমের দাম বাড়ার ফলে এটা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমিষ বাদ দিয়েও যখন সংসার চালাতে হিমশিম খান তখন এসব মানুষ খাবার কমিয়ে দেন। দেখা যায় তিন বেলার জায়গায় দুই বেলা খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। এভাবে খাবার নিয়ন্ত্রণ করে চলতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে এক পর্যায়ে হতাশা পেয়ে বসে অনেক দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষকে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সামাজিক নিরাপত্তাবলয় জোরদারের বিকল্প নেই।
আর বাজারে নজরদারি ও তদারকির বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে পণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে জরুরি বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা। খেয়াল রাখতে হবে পণ্য যেন বাজার থেকে উধাও হয়ে না যায়। সরবরাহ না থাকলেই বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়। সম্প্রতি ভোজ্যতেল উধাও হয়ে যাওয়ার পর ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল উদ্ধার করে। যাদের কাছ থেকে এসব তেল উদ্ধার করা হয় তারা কেউ অনুমোদিত ডিলার নয়। তার মানে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পরে বেশি দামে বিক্রির অসৎ উদ্দেশ্যে এসব তেল মজুত করে রেখেছিল খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
ভোজ্যতেলের পর এখন আবার চালের বাজারেও সেই সংকট দেখতে পাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, মিলার ও খুচরা বাজারে কোনো কারসাজি আছে কিনা- সেটা খুঁজে বের করতে হবে। যদি চালের বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখা না যায় তাহলে চাহিদার তুলনায় জোগান সীমিত অজুহাতে চালের দাম বেড়ে যাবে। যদিও সরকার এরই মধ্যে অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। খুচরা বাজার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে বড় বড় কৃষক ও রাইস মিলারদের দিকে নজরদারি বাড়িয়ে দিতে হবে। যেন তারা গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে। কাজগুলো অত সহজ নয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও দক্ষতা থাকলে অসম্ভবও হতে পারে না।
বাজার নিয়ে সময়ে এক ফোঁড় দিতে না পারলে অসময়ে দশ ফোঁড় দিয়েও লাভ হবে না।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

আরও পড়ুন

×