বইবন্দি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ জুন ২০২২ | ১৪:৫৮
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যেভাবে বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে ঠিক সেভাবেই বাড়ছে তার বর্জ্য। আমরা দেখছি, অব্যবস্থাপনার কারণে অন্যান্য গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে এসব ই-বর্জ্যের স্থান হয় ডাস্টবিনে। স্বাভাবিকভাবেই এসব বর্জ্যে থাকা নানা ধরনের রাসায়নিক যেমন মাটি ও পানিকে দূষিত করছে, তেমনি নানাভাবে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে রোগের ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে রোববার সমকালে প্রকাশ হয় 'পরিবেশের পাঁজর ভাঙছে ই-বর্জ্য'। আমরা বিস্মিত, ই-বর্জ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে অন্তত এক যুগ ধরে আলোচনা চললেও সরকারের পক্ষ থেকে তার যথাযথ ব্যবস্থাপনায় তেমন পদক্ষেপ এখনও আমরা দেখিনি। গত বছর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিধিমালা করা হলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে।
ই-বর্জ্য বিধিমালায় বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্য থেকে সৃষ্ট বর্জ্য উৎপাদনকারী বা সংযোজনকারীকে ফেরত নেওয়ার কথা থাকলেও তা কেতাবেই আছে। বিধিমালা অনুসারে, ই-বর্জ্য ফেরত নেওয়ার সময় উৎপাদনকারীর কাছ থেকে সরকার-নির্ধারিত অর্থ প্রণোদনা পাবেন গ্রাহক। একই সঙ্গে অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ সরকারের অন্যান্য সংশ্নিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ই-বর্জ্য সংগ্রহ, পুনর্চক্রায়ন, পুনর্ব্যবহার ও ধ্বংস সম্পর্কিত কার্যাবলি তদারকির কথা থাকলেও এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় ই-বর্জ্য ফেলার আলাদা জায়গার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন না হওয়াটা দুঃখজনক।
খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, ওই বছর দেশে চার লাখ টন ইলেকট্রনিকস বর্জ্য জমা হলেও এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ব্যবহার করা হয়। বাকি ৯৭ শতাংশ ভাগাড়ে চলে যাওয়াই প্রমাণ করছে, আমরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। ই-বর্জ্য থেকে ক্ষতিকর ধাতব উপাদান পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলার ফলে তার প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের ওপরেও পড়ছে। ই-বর্জ্য বৃদ্ধির পেছনে মোবাইল ফোনের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা জানি, দেশে প্রায় জনসংখ্যার সমসংখ্যক মোবাইল ফোন রয়েছে এবং প্রতিবছর এসব ফোনের ১৭-১৮ কোটি ব্যাটারি থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনসেট, চার্জার, ফোনের কভারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তা ছাড়া টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সামগ্রীর ই-বর্জ্য তো রয়েছেই।
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারের উদাসীনতা যেমন সত্য তেমনি বেসরকারি উদ্যোগও নগণ্য। অভিযোগ রয়েছে, প্রণোদনার অভাবে অনেকেই এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। তার পরও যেসব প্রতিষ্ঠান ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে ভূমিকা রাখছে, আমরা তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে সরকারকে নীতিগতভাবে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি বেসরকারি উদ্যোগকেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাজের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বিশেষত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, পরিকল্পিতভাবে ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করে রপ্তানির যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে পারলে একদিকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজ হবে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও নতুন পথ খুলবে।
সমকালের আলোচ্য প্রতিবেদন অনুসারে, সরকার ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর বিষয়ে দৃষ্টি দিচ্ছে। সে জন্য সাড়ে তিনশ কোটি টাকার প্রকল্পের কথাও ভাবছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং এ নিয়ে আর সময়ক্ষেপণ কাম্য নয়। একই সঙ্গে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী আইনি কাঠামোতে আনা প্রয়োজন। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যেন কেবল বিধিমালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, তাও নিশ্চিত করা চাই। মেয়াদোত্তীর্ণ বা নষ্ট হওয়া বৈদ্যুতিক পণ্য নির্দিষ্ট স্থানে রাখা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বিধিমালা বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা প্রত্যাশিত।
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জনসচেতনতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকে যাতে নির্দিষ্ট স্থানে ই-বর্জ্য রাখে সে ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করে তোলা চাই। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত বিলাসিতার জন্য বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা দরকার। ই-বর্জ্য অবস্থার আলোকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ, পুনঃব্যবহার কিংবা ধ্বংসকরণে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ই-বর্জ্য প্রযুক্তির এ সময়ের অনিবার্য বাস্তবতা। একে উপেক্ষা করার যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি তার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও উদাসীন থাকা বিপজ্জনক।