সমকালীন প্রসঙ্গ
জ্বালানি আমদানিই শেষ ভরসা?

সবুজ ইউনুস
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২২ | ০০:০৬
২০১৯ সালের ৩ জুলাই সমকালে 'আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে জ্বালানি খাত' শিরোনামে আমার একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালের আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশে লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস তথা এলএনজি আমদানি শুরু হয়েছিল।
অনেকেই জানেন, সাগরপথে বড় জাহাজে করে সহজে বহনের সুবিধার্থে প্রাকৃতিক গ্যাসকে কৃত্রিমভাবে তরল করা হয়। এটাই এলএনজি। এ জন্য আগেই মহেশখালী দ্বীপসংলগ্ন গভীর সাগরে একটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। বড় একটি ভাসমান জাহাজই এই টার্মিনাল। আমদানি করা এলএনজি এখানে আবার পরিশোধন ও বায়বীয় গ্যাসে রূপান্তরের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন করা হয়। আমদানি করা এই গ্যাস এবং দেশের বিভিন্ন খনি থেকে তোলা গ্যাস জাতীয় সঞ্চালন পাইপলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে বাসাবাড়ি, শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন সংস্থায় সরবরাহ করা হয়।
এখন দেখা যাচ্ছে, আমদানির পরও বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। সম্ভবত পাইপলাইনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে সংযোগ আর দেবে না সরকার। কারণ সস্তায় গ্যাস পোড়ানোর দিন শেষ হয়ে এসেছে। এখন বাসাবাড়িতে সিলিন্ডার গ্যাস পুড়িয়ে রান্নাবান্না করতে হবে। এদিকে সিএনজি স্টেশনে অব্যাহত রয়েছে গ্যাস রেশনিং। শিল্পকারখানায়ও স্বল্প চাপ সমস্যা দূর করা সম্ভব হয়নি। দেশে বর্তমানে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুটের বেশি। কিন্তু সেখানে সরবরাহ করা হচ্ছে কমবেশি ২৮০ কোটি ঘনফুট। দেশে সরবরাহকৃত গ্যাসের ২০ ভাগ আমদানি করা হচ্ছে। বাকিটা উৎপাদন হয় দেশেই। কিন্তু ওই ২০ ভাগ গ্যাস আমদানির আর্থিক চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশে যে ৮০ ভাগ উৎপাদন হচ্ছে, ওই গ্যাসের দাম ২০ হাজার কোটি টাকা। দেশীয় গ্যাসের চেয়ে বিদেশি গ্যাসের দাম ৫ গুণ। সম্প্রতি ইউক্রেন সংকটের কারণে তেল-গ্যাসের দাম আরও বেড়েছে। এ জন্য গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হয়েছে। জ্বালানি তেলের দামও শিগগিরই বাড়তে পারে। দেশে ৫১ ভাগ বিদ্যুৎ এখনও গ্যাস পুড়িয়েই উৎপাদন করা হচ্ছে।
মনে আছে, নব্বইয়ের দশকে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্র লিখেছিল- বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ- ২০০০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতে গ্যাস রপ্তানির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ওই অনুরোধ বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। বলেছিলেন, ৫০ বছর মজুত রেখে যদি উদ্বৃত্ত থাকে তাহলে বাংলাদেশ গ্যাস রপ্তানি করবে। ভাগ্যিস, সেদিন গ্যাস রপ্তানির অনুরোধে সাড়া দেওয়া হয়নি। দিলে এতদিনে বাংলাদেশের সব গ্যাসই সম্ভবত নিঃশেষ হয়ে যেত। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
বেশ কয়েক বছর থেকেই দেশে গ্যাস উৎপাদন দ্রুতগতিতে কমছে। অনেক চেষ্টা করেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার সম্ভব হয়নি। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদনও বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে; হচ্ছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। বাড়ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। বাড়ছে গ্যাসের চাহিদাও। নতুন গ্যাস আবিস্কার না হলে আমাদের মজুত পুরোটাই শেষ হয়ে যাবে ২০৩০ সালের মধ্যে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ, সারসহ যত কারখানা আছে তা সচল রাখতে হলে ২০৩০ সালের আগেই পুরো গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা করতে হবে। অথবা দেশে নতুন গ্যাস আবিস্কার করতে হবে।
দেশে বেশ কয়েকটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। এর মধ্যে পায়রা বড় কেন্দ্র। উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। এ বছরই চালু হবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর পর ধারাবাহিকভাবে মাতারবাড়ীসহ আরও কয়েকটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। এ জন্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানি করতে হবে। কারণ দেশের খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার মতো প্রযুক্তি আমাদের নেই। বড়পুকুরিয়া খনি থেকে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হয়। সেখানে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। এই কয়লা দিয়ে সেটা চালানো হয়। বাকি আরও চারটি কয়লা খনি আছে। সেখান থেকে উন্মুক্ত ছাড়া সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা তোলার সুযোগ সীমিত। ফলে কয়লা আমদানি ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না।
এখন বছরে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল লাগে, যার পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে ৫০ লাখ টন ডিজেল। দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র, পরিবহন ও সেচকাজে ব্যাপকভাবে এই ডিজেল ব্যবহার হয়। বাস-ট্রাকও চলে ডিজেল দিয়ে। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন ডিজেলনির্ভর। ফার্নেস অয়েল দিয়ে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হয়। গ্রামগঞ্জে এখনও কমবেশি কেরোসিনের ব্যবহার আছে। প্রাইভেটকার চলে পেট্রোল-অকটেন দিয়ে।
জ্বালানি তেল বলতে গেলে পুরোটাই আমদানি করতে হয়। গ্যাস ও কয়লা আমদানি দিনের পর দিন বাড়ছে। ভবিষ্যতে এ আমদানি বাড়তেই থাকবে। একটি পর্যায়ে হয়তো দেশের পুরো জ্বালানি চাহিদাই আমদানি করে পূরণ করতে হবে। তা ছাড়া আর কোনো উপায় আপাত দেখা যাচ্ছে না।
গ্যাসসহ জ্বালানি খাতে আরও দুঃসংবাদ আছে। প্রথমত, গভীর সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানি পাওয়া কঠিন হবে। ফসিল ফুয়েলে বিনিয়োগ থেকে সরে আসছে বহুজাতিক বড় কোম্পানিগুলো। এ খাতে বিনিয়োগ হয় দীর্ঘমেয়াদি। আগামী ২০-৩০ বছরে ফসিল ফুয়েলের পরিণতি কী হয়, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ বিশ্ব এখন গ্রিন এনার্জির দিকে যাচ্ছে। এ ছাড়া কপ২৬ সম্মেলনে ফসিল ফুয়েলকে নিরুৎসাহিত করার বিষয়ে বিভিন্ন দেশ একমত হয়েছে। বিশেষ করে গ্যাস ও কয়লা উন্নয়ন খাতে কোনো কোম্পানি বিদেশে গিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবে না- এই মর্মে সবাই একমত। ফলে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে নতুন করে গ্যাস উৎপাদন করা কঠিন হবে।
এদিকে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান করার কোনো অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা নেই দেশীয় কোম্পানি বাপেক্সের। তা ছাড়া গভীর সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। সরকারের পক্ষে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যাওয়া কঠিন। স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে সংশ্নিষ্ট খাতের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয়েছে। স্থলভাগ নিয়ে কেউই আশার বাণী শোনাতে পারেননি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেল, তা হলো, স্থলভাগে খুব বড় কোনো গ্যাসের খনি পাওয়ার সুযোগ সীমিত। আগে একটা সময় ছিল যখন প্রতি দুই অথবা তিনটি কূপ খুঁড়লেই একটা নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার হতো। এখন ৬-৭টা খুঁড়েও গ্যাস মিলছে না। সর্বশেষ যে কয়েকটি কূপ খনন হয়েছে, সবই হতাশ করেছে।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা 'হাইপ্রেশার জোন' বিষয়ে সীমিত আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর যে স্তর থেকে আমরা গ্যাস তুলছি, তারও গভীরে হাইপ্রেশার জোনে গ্যাস থাকতে পারে; যদিও বিশাল কোনো মজুত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সবকিছু মিলিয়ে দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।
তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? জ্বালানি তেল বহু আগে থেকেই আমদানি করতে হয়। পুরো চাহিদাই পূরণ করা হয় আমদানি করে। কয়লা খনি ৫টি। এ মধ্যে বড়পুকুরিয়া থেকে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হচ্ছে। অন্য চারটি খনি থেকে কয়লা তোলা নিয়ে নানা জটিলতা আছে। এই খনিগুলো থেকে আদৌ কয়লা তোলা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। ফলে কয়লা আমদানি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। গ্যাসের কথা আগেই বিস্তারিত বলেছি। ফলে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি জ্বালানি খাতে আমরা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছি। কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো দেখা যাবে পুরো জ্বালানিই আমদানি করতে হচ্ছে। তখনকার কথা ভেবে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। সাশ্রয়ী তো হতেই হবে। এ ছাড়া দৃশ্যত বিকল্প নেই।
সবুজ ইউনুস: সহযোগী সম্পাদক ও অনলাইন ইনচার্জ, সমকাল
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ
- জ্বালানি
- সবুজ ইউনুস