অন্যদৃষ্টি
বাংলাদেশেও 'কামরাজ প্ল্যান'?

সুধীর সাহা
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২২ | ১২:০০
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমল। সালটা ১৯৬২। তৃতীয়বার নির্বাচিত হয়ে নেহরু তখন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে আসীন; কিন্তু স্বস্তিতে ছিলেন না। এর সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কারণ ছিল চীনের অনুপ্রবেশ। লাদাখ সীমান্তে সে সময় চলছিল লাল ফৌজের দাপট। দেশের মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। লালবাহাদুর শাস্ত্রী পণ্ডিতজিকে পরামর্শ দিলেন ছোট একটি আহুতি দিতে। বুঝলেন নেহরু। সরিয়ে দেওয়া হলো প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননকে। মানুষের উদ্বেগ ও ক্ষোভের ক্ষতে খানিকটা প্রলেপ। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হলো না। পণ্ডিতজি বুঝলেন, কংগ্রেসের ওপর থেকে আস্থা সরে যাচ্ছে মানুষের। দলের নেতারা কিছুতেই সাধারণের সঙ্গে কানেক্ট করে উঠতে পারছেন না। দেশবাসীর কাছে তাঁরা যেন বহু দূরের; যেন ভিন গ্রহের জীব। কী করা যায়?
আসরে নামলেন মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী এবং নেহরু-ঘনিষ্ঠ নেতা কুমারস্বামী কামরাজ। বললেন, আপনার হাতে আছে সরকার, দল। মন্ত্রিত্ব নিয়ে যাঁরা বছরের পর বছর জাঁকিয়ে বসে রয়েছেন, তাঁদের সবাইকে সরিয়ে দিন। তাঁরা সবাই পার্টির কাজে ফিরবেন। মানুষ আবার তাদের চেনা-পরিচিত নেতাদের নিজেদের মধ্যে পাবে। আর নতুন মুখ নিয়ে আসুন মন্ত্রিত্বে। পূর্ণ উদ্যমে কাজ করবেন তাঁরা। শুধু আপনি থেকে যান স্বপদে। কেননা, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার একটা আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আছে। নেহরু বুঝলেন- এটাই হবে ভালো দাওয়াই। সেটাই করেছিলেন নেহরু। ফলও পেয়েছিলেন ভোটে। চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা-ই প্রমাণ করলেন তিনি। ভারতের রাজনীতিতে এটাই মিথ হয়ে যায় 'কামরাজ প্ল্যান' নামে। কামরাজ এখন আর নেই, কিন্তু তাঁর প্ল্যানটি আজও পুরো মাত্রায় ফলপ্রসূ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং পরপর তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থা অনেকটাই জওহরলাল নেহরুর মতো। শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। সেই জায়গায় সরকার কিংবা বিরোধী রাজনীতিতে এখনও কেউ পৌঁছাতে পারেননি। তবে ২০০৯ থেকে প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিরোধিতার হাওয়া গায়ে লাগতেই পারে। এটা প্রচলিত রাজনীতির বাস্তবতা। আর তার সঙ্গে আছে কভিড-পরবর্তী আর্থিক সংকট। বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারত্ব, বেহাল অর্থনীতি, আকাশছোঁয়া পেট্রোল-ডিজেল, অগ্নিমূল্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের। রাজনৈতিক হাওয়ায় সরকারের বিরোধিতা করতে এসব উপাদান একেবারেই সোনায় সোহাগা হয়ে কাজ করে।
বস্তুত বিক্ষুব্ধ হওয়ার মতো অনেক পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ জিনিসপত্রের দাম নিয়ে দিশেহারা। আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো খরচ কমাতে হচ্ছে। জমানো টাকার ওপর ব্যাংকে যা সুদের হার পাওয়া যেত, সেটা কমতে কমতে তলানিতে। শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে আগুন। বেকারত্ব রেকর্ড সৃষ্টি করছে। পাড়ায় যে তরুণ-তরুণী ব্যবসা করতে চাচ্ছে; সে বুঝতে পারছে না- আজকের এ যুগে ঠিক কোন ধরনের দোকান দিলে সংসার চালানোর মতো রোজগারটা হয়ে যাবে। কোন ব্যবসাটা গত পাঁচ বছরে প্রবলভাবে লাভের মুখ দেখছে। চাকরি, ব্যবসাগত প্রফেশনাল থেকে অটোরিকশাচালক; সবার মধ্যে একটা কথাই শোনা যায়- আগের মতো টাকা জমাতে পারি না। তাই প্রশ্ন জাগছে, যাদের মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয়, এ সংসারগুলো চলছে কীভাবে? এই যে ওপরে বর্ণিত পরিস্থিতি, এটা আমরা সবাই দিনযাপনে উপলব্ধি করছি। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা কথাগুলো মানতে চাচ্ছেন না। তাঁরা বরং বলে বেড়াচ্ছেন, আমাদের দেশ আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল, যথেষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ, যথেষ্ট শক্তিশালী।
সরকারের মন্ত্রীরা যখন বাস্তবতা সম্পর্কে উদাসীন থাকেন, তখন সমাজ ও রাজনীতিতে নানা রকম বিভাজনের বীজ রোপিত হতে থাকে। সরকারের জন্য বাড়ে জনপ্রিয়তা হারানোর আশঙ্কা, আর জনগণের জন্য বাড়ে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এমন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সরকারের নিজেকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। প্রশ্নের উত্তরটি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকেই খুঁজে বের করতে হবে। তাঁকে ভেবে দেখতে হবে- ভারতে এক সময় কামরাজের পরিকল্পনা যেমন জওহরলাল নেহরুকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল; আজ তেমন কোনো পরিকল্পনা রাজনীতিকেও বাঁচাতে পারবে কিনা!
সুধীর সাহা: কলাম লেখক
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- সুধীর সাহা