ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জ্বালানি

লোডশেডিং কার্যকর সমাধান নয়

লোডশেডিং কার্যকর সমাধান নয়

সবুজ ইউনুস

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২২ | ১৩:৫৬

বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন অচল। কিন্তু বিদ্যুৎ এমনই একটি পণ্য, যা মজুত করা যায় না। যখন যতটুকু উৎপাদন হয়, তখনই ততটুকু ব্যবহূত হয়। আবার জ্বালানি ছাড়া এই 'মহাশক্তিশালী' পণ্যটি উৎপাদন করা যায় না। এটি উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয় ডিজেল, ফার্নেস, গ্যাস, কয়লা, পানি, বাতাস, সূর্যের আলো ইত্যাদি। গ্রিন এনার্জির কথা বলে যদিও পরিবেশবাদীদের মুখ ব্যথা হয়ে গেছে; এখনও ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়েই বিশ্বের ৮০ শতাংশ শক্তি বা বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

এদিকে জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লার মূল্য আকাশচুম্বী। কারণ করোনার তেজ কমতে না কমতেই অনেকটা আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যে যুদ্ধ বিশ্বের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিচ্ছে। মূল্যস্ম্ফীতি যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন রেকর্ড করছে। বৈশ্বিক এই সংকটে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা সর্বাধিক ঝুঁকির মুখে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ বুঝে ফেলেছে, ব্যয় সংকোচন ছাড়া উপায় নেই। সাশ্রয়ী না হলে বিপদ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশও সাশ্রয়ের পথে হাঁটছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর একটি হলো 'পরিকল্পিত লোডশেডিং'।

মনে রাখতে হবে, পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের মূলে রয়েছে জ্বালানি সাশ্রয়ের চিন্তা। প্রশ্ন হচ্ছে 'সাশ্রয়' করব কোথায়? আমরা জানি, দেশের মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস আমদানি করতে হয়। ওই ২০ শতাংশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত স্বাভাবিক মূল্যে আমরা ১৫ শতাংশ গ্যাস ওমান ও কাতার থেকে আমদানি করে থাকি। বাকি যে ৫ শতাংশ গ্যাস; এটা খোলাবাজার থেকে অতিরিক্ত দামে আমদানি করতে হচ্ছিল। এখন সেটা বন্ধ। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ আগের মতোই স্বাভাবিক। এই ৫ শতাংশ গ্যাস ঘাটতির কারণে ইতোমধ্যে দুটো সার কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাফকো সার কারখানায় গ্যাস বন্ধের সুযোগ নেই। কারণ চুক্তি অনুযায়ী এখানে গ্যাস সরবরাহ করতে সরকার বাধ্য। এ ছাড়া যা-ই হোক, কৃষি উৎপাদন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। কারণ এই সংকটকালে কৃষিই আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন হতে পারে। ওদিকে রপ্তানিমুখী শিল্পেও উৎপাদন সচল রাখতে হবে। এ জন্য বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে হবে রপ্তানিমুখী শিল্পে। এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক অঞ্চলের সীমানা সুনির্দিষ্ট নয়। ফলে খাতভিত্তিক লোডশেডিং সম্ভব নয়। তার মানে, পরিকল্পিত লোডশেডিং করতে গিয়ে সার ও পোশাক কারখানার মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাতের উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে।

বস্তুত বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং করে প্রকৃতপক্ষে কোনো খাতেই লাভ হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং এতে ডিজেল-কেরোসিনের অপচয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ বাসাবাড়ি বা দোকানপাটে যখনই বিদ্যুৎ চলে যায়, তখনই ডিজেল জেনারেটর চালু করা হয়। বিদ্যুৎবিহীন ১ মিনিটও কেউ থাকতে চান না। ফলে যে ডিজেল সাশ্রয় করার জন্য ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হলো; তাতে কতটুকু লাভ হলো, তা নিয়ে সংশয় আছে।

লোডশেডিংয়ের শিডিউল ছাড়াই বিভিন্ন এলাকায় বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়া অব্যাহত থাকলে খুচরা ডিজেল বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে। পাড়া-মহল্লায় ডিজেল সংকটের কারণে নতুন কোনো পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা আছে। আমাদের বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন, ট্রান্সফর্মার বহু স্থানে এখনও পুরোনো। লাইন ওভারলোডেড হয়েও বহু স্থানে শিডিউলের বাইরে কয়েকবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। এটা ঘাটতিজনিত কোনো লোডশেডিং নয়; বিভ্রাট। যে কারণে আগাম শিডিউল জানিয়ে দিয়ে সেই মোতাবেক লোডশেডিং করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে গ্রাহকরাও বিরক্ত হচ্ছে। কারণ লোডশেডিংয়ের অভ্যাস থেকে জনগণ এক প্রকার বের হয়ে এসেছিল।


দেশে ১০টি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১২০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরকারি ছোট তিনটি কেন্দ্র বন্ধ দীর্ঘদিন। এর বাইরে ছয়টি বেসরকারিসহ সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দিনে দুই-তিন ঘণ্টার বেশি চালানো হতো না। তাও প্রতিদিন নয়; চালানো হতো যখন বিদ্যুতের চাহিদা খুব বেশি থাকে তখন। কারণ, এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি; ইউনিটপ্রতি প্রায় ৪০ টাকা। প্রশ্ন হলো, এগুলো কেন চালাতে হবে এখন? ক্যাপটিভ বাদ দিলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ২২ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। আমাদের সর্বোচ্চ চাহিদা আছে প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। অন্যান্য ফুয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে সহজেই এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো কেন চালাতে হবে? এগুলো এখন বন্ধ রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলে বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার টনের মতো ডিজেল সাশ্রয় হবে। এটা সত্য। তবে লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট টানা চলতে থাকলে ওই ডিজেল বাসাবাড়ি, দোকানপাটে ছোট ছোট জেনারেটরে ব্যবহূত হবে। এটা সাশ্রয় হবে না। দেশে বছরে ডিজেলের চাহিদা ৪৬ লাখ টন।

সারাদেশে ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত গভীর নলকূপ রয়েছে কয়েক লাখ। বিদ্যুৎ ও ডিজেলের অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক এই সংকটকালে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে খাদ্য নিরাপত্তা ও রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে। এখানে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে লোডশেডিং কোনো কার্যকর সমাধান নয়। যেহেতু আমাদের পর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতা আছে, সেহেতু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা উচিত। কারণ এই বিদ্যুৎ সার্বিক উৎপাদন খাতে ভ্যালু অ্যাড করছে। আর লোডশেডিং উৎপাদন ব্যাহত করছে। লোডশেডিং করে উল্লেখযোগ্য কোনো সাশ্রয় হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।

প্রকৃতপক্ষে যতটুকু সাশ্রয় হচ্ছে সেটা রাত ৮টায় দোকানপাট বন্ধ করার কারণে। এটি একটি প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। দিনের অন্যান্য যে কোনো সময়ের চেয়ে সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা থাকে অনেক বেশি। কমবেশি ২ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা বাড়ে এ সময়ে। রাতে দোকানপাট বন্ধ করার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানিও সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে এসিসহ বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিয়ে সরকারের যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে পালন করা হলে সুফল মিলবে। তবে এ মর্মে গণমাধ্যমে প্রচার চালানো উচিত। জনগণকে সচেতন করার জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে।

বর্তমানে প্রচণ্ড গরম পড়ছে। সে কারণে বিদ্যুতের চাহিদাও বেশি। আগস্ট মাসেও হয়তো গরমের তীব্রতা কমবেশি থাকতে পারে। সেপ্টেম্বর মাসে তীব্রতা অনেকটা কেটে যাবে। শীতের হালকা আমেজ আসবে। আশা করা যায়, অক্টোবর মাস থেকে শীতকাল শুরু হবে। তখন বাসাবাড়ি, এমনকি অফিস-আদালতেও এসির ব্যবহার কমে আসবে। চাহিদা অনেক কমে আসবে বিদ্যুতেরও। সাধারণত শীতকালে বিদ্যুতের ব্যবহার চার থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট কমে আসে। ফলে এটা সবার জন্য স্বস্তির খবর। আর কিছুদিন কষ্ট করলেই সামনে লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ থেকে হয়তো মুক্তি পাওয়া যাবে। তা ছাড়া এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানিও সাশ্রয় হবে।

সবুজ ইউনুস: সহযোগী সম্পাদক ও অনলাইন ইনচার্জ, সমকাল

আরও পড়ুন

×