ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জ্বালানি সাশ্রয়

কর্মঘণ্টা পরিবর্তনের সঙ্গে আরও যা করতে হবে

কর্মঘণ্টা পরিবর্তনের সঙ্গে আরও যা করতে হবে

সবুজ ইউনুস

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২২ | ১২:০৮

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এবার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মঘণ্টা কমিয়ে নতুন দাপ্তরিক সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ বুধবার থেকে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মঘণ্টা সকাল ৮টায় শুরু হয়ে বিকেল ৩টায় শেষ হবে। অবশ্য জরুরি পরিষেবার অফিসগুলো এ আদেশের বাইরে থাকবে।
এটা ঠিক, বর্তমান জ্বালানি সংকটকালে সাশ্রয়ী হওয়ার বিকল্প নেই। আমাদের জ্বালানি আমদানি করে চলতে হয়। ফলে সাশ্রয়ী হতেই হবে। নতুন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যদিও মোট কর্মসময় এক ঘণ্টা কমে আসবে; দিনের আলো ব্যবহারের কারণে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে এবং যানজট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জ্বালানি অপচয় রোধ হবে।
আমরা জানি, আগে থেকেই বিদ্যুতের লোডশেডিং ব্যবস্থাপনা চলছিল। তবে শুধু লোডশেডিং করে যে ভালো ফল পাওয়া কঠিন- ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়েছে। শুধু কর্মঘণ্টা পরিবর্তনও ধন্বন্তরি নয়। আমি মনে করি, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের আরও যেসব উপায় আছে, সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সাশ্রয় করা যাবে জ্বালানি তেল। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমানোও সম্ভব হবে।

বিলম্বে হলেও আমাদের 'স্বভাব দোষ' নিয়েও পর্যালোচনা জরুরি। আমরা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করি না। যেমন কিছু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশ আগেই উৎপাদনে আসার কথা ছিল। কিন্তু এগুলো চালু করার কাজটি সময়মতো সম্পন্ন করা যায়নি। যেমন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটা অনেক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। যথাসময়ে চালু হলে ছোট ছোট রেন্টালের চুক্তি নবায়ন করতে হতো না। এগুলো বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট গুনতে হতো না। ডিজেল বা ফার্নেসচালিত কেন্দ্রগুলো সহজেই বন্ধ রাখা যেত। ফলে তেলের ওপর চাপ কম পড়ত। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুঃখের বিষয়, যথাসময়ে সঞ্চালন লাইন করা যায়নি। ফলে জাতীয় গ্রিডে পুরো বিদ্যুৎ আনা সম্ভব হচ্ছে না। খুলনা অঞ্চলেই এটা বিতরণ করা হচ্ছে। এই সঞ্চালন লাইন নির্মাণে কেন দেরি হলো? এই দুঃসময়ে যদি পায়রার বিদ্যুৎ আনা যেত, তাহলে হয়তো ঢাকায় লোডশেডিং কমানো সম্ভব হতো। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন খরচ তেলের চেয়ে অনেক কম। এসব সমস্যার কারণে বেসরকারি এই তেলনির্ভর কেন্দ্রগুলোর চুক্তি বারবার নবায়ন করতে হয়েছে। এই ভুলের জন্য বর্তমানে খেসারত দিতে হচ্ছে।

যাহোক, এখন যেভাবেই হোক নির্মাণাধীন বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। বড় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে ভাড়াটে ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অর্থাৎ, এগুলো আর নবায়ন করার দরকার হবে না। সরকারি মালিকানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বেসরকারি মালিকানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হবে। গত এক দশকে ক্যাপাসিটি পেমেন্টের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের পকেটে গেছে। এখনও দিতে হচ্ছে। এটা কমাতে হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চুরি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সিস্টেম লস কমাতে জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্যাস খাতে এখনও ৮ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস। যেখানে গ্রহণযোগ্য সিস্টেম লস ২ থেকে আড়াই শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিন ২০ কোটি থেকে ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। এই চুরি বন্ধ করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যের স্পট মার্কেট থেকে অতিরিক্ত বেশি দামে গ্যাস আমদানি করা লাগবে না। সরকার চাইলে এই চুরি বন্ধ করা সম্ভব। বিদ্যুতে এখনও সিস্টেম লস গড়ে ১০ শতাংশের ওপরে। সিস্টেম লস ৫ শতাংশ কমিয়ে গ্রহণযো্য মাত্রায় আনতে পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।  
চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই বিদ্যমান রেন্টাল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। কোনোভাবেই এগুলো আর নবায়ন করা যাবে না- এ মর্মে সরকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সম্ভাব্য ঝুঁকি সামাল দিতে দেশে চাহিদার চেয়ে কিছুটা উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু এত বেশি উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ আপাতত দরকার নেই।
আমাদের মতো দেশে ১০ শতাংশ উদ্বৃত্ত উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেই যথেষ্ট।

আমাদের মতো ঘনবসতির দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ সীমিত। তবুও জরুরি ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। কারণ, উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম। এ জন্য এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। 
গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে গভীর সাগরে জোরালো অনুসন্ধান জরুরি। এ জন্য নতুন করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির কাছে ইজারা দিতে হবে। কারণ, সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের মতো সক্ষমতা আমাদের দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স বা অন্য কারও নেই। ঝুঁকিপূর্ণ এই বিনিয়োগ সক্ষমতাও আমাদের নেই। স্থলভাগে অনুসন্ধান ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাপেক্সসহ বিদেশি কোম্পানিকে লাগানো যেতে পারে।

বর্তমানে রাশিয়া থেকে তুলনামূলক কম মূল্যে গ্যাস আমদানির সুযোগ আছে। অবশ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে এই দেশ থেকে আমাদের পক্ষে গ্যাস আমদানি করা সম্ভব হবে কিনা, সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো দেশের সঙ্গে এলএনজি আমদানির চুক্তি করা যায় কিনা, ভেবে দেখা যেতে পারে।

সরকারি-বেসরকারি অফিস, সুপার মার্কেট, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসির সীমিত ব্যবহারসহ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের আলোকসজ্জা বা বিদ্যুৎ অপচয় করা যাবে না।

গৃহস্থালিতে বিদ্যুৎ জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারি ওয়েবসাইটে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেমন টিউবলাইট ভালো মানের হলে বা এনার্জি সাশ্রয়ী বাল্ক্ব ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। বিভিন্ন পয়েন্টে অযথা চার্জার লাগিয়ে রাখলেও বিদ্যুৎ খরচ হয়। প্রয়োজন ব্যতীত ওভেন, ফ্যান, পিসি ইত্যাদি বন্ধ করে রাখা উচিত। অনেক বিদ্যুৎ খাওয়া ওয়াশিং মেশিন, কাপড়ের ইস্ত্রি পিক আওয়ারে চালানো ঠিক না। ফ্যান ছেড়ে কাপড় না শুকানো, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় লাইট ও ফ্যানের সুইচ বন্ধ করা জরুরি। কিন্তু এগুলো এখানে প্রচার করেই বসে থাকলে চলবে না। এ বিষয়ে জনমত গঠনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
লোডশেডিং ব্যবস্থাপনা, কর্মঘণ্টা পরিবর্তনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে অন্যান্য পন্থাও অবলম্বন করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অবিলম্বে জাতীয় কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

সবুজ ইউনুস :সহযোগী সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×