ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

মতামত

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর রাজকীয় দায়মুক্তি

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর রাজকীয় দায়মুক্তি

সরকারি কর্মচারীদের বিদ্যমান মানসিকতার মধ্যে তাদের গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতির বিধান খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকত। আদালত সে বিধান বাতিল করে নিঃসন্দেহে জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মাহফুজুর রহমান মানিক

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২২ | ০৭:৫৯ | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২২ | ০৮:৫৬

সংবিধানে যেখানে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, সেখানে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতির বিষয়টি যে বৈষম্যপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত ২৪ আগস্ট ফৌজদারি মামলায় সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতির বিধান রেখে তিন বছর আগে কার্যকর হওয়া 'সরকারি চাকরি আইন' নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে উচ্চ আদালত যে মন্তব্য করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। এমন বিধানের মানে হচ্ছে, বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে দায়মুক্তি দেওয়া এবং এমন বিধান দুর্নীতিতে উৎসাহ জোগাবে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণের পর কয়েক দফা শুনানি শেষে ২৫ আগস্ট আদালতের এক রায়ে বাতিল করা হয়েছে বিতর্কিত ওই বিধান। 

সরকার পক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। সে সুযোগ তাদের রয়েছে বটে, কিন্তু এ রায়ের মাধ্যমে যে সত্যটি সামনে এসেছে, তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সংবিধান অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক। বস্তুত তারা 'সরকারি' নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১-এর ২-এ বলা হয়েছে, 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য'। সংবিধানের এ ধারাটি সরকারি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুধাবন করা জরুরি। আমরা দেখি সরকারি অনেক অফিসে বড় করে লেখা থাকে- 'আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত'। এরপর সেখানে দুর্নীতি ধরা পড়ে। আমি মনে করি, এর পরিবর্তে সেখানে সংবিধানের এই ধারাটি বরং লেখা উচিত। তারা যখন পড়বে 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য', তখন সেবার জন্য যাওয়া মানুষ হেনস্তার শিকার হওয়ার কথা নয়। এমনকি দুর্নীতি করার ক্ষেত্রেও তারা তাদের কর্তব্যের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। 

কোনো ব্যক্তি যখন খুন, মারামারি, চুরি, ডাকাতি, মাদক, প্রতারণা, ধর্ষণ, অপহরণ, জালিয়াতি, মিথ্যা সাক্ষ্যদান প্রভৃতি অপরাধ করেন, তখন তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দেওয়া হয়। সামাজিক শৃঙ্খলার জন্যই এসব অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীকে দ্রুত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়। কোনো সরকারি কর্মচারী এসব অপরাধ করলেও কেন তার গ্রেপ্তারের জন্য অনুমতি নিতে হবে? সাধারণ মানুষকে যেভাবে পাকড়াও করা হয়, সেই মানুষদের 'সেবক'দের জন্য বিধান ভিন্ন হবে কেন? 

বস্তুত সরকারি কর্মচারীদের আইনেও বিষয়টি ছিল। ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী 'সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮'-এর ৪১(১) ধারায় বলা হয়, 'কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হইলে, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে।' বলাবাহুল্য, যখন ২০১৯ সালে আইনটি কার্যকর হয় তখনই এ নিয়ে সমালোচনা হয়। এমনকি আইনটির ৪১(১) ধারা চ্যালেঞ্জ করে তখনই জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। তারই রায় হলো গত সপ্তাহে। নৈতিকতার বিচারে শেষ পর্যন্ত এ রায়টিই বহাল থাকার কথা। সরকারপক্ষের আপিলের পর পাল্টা রায় হবে কিনা, সেটাও দেখার বিষয়। যদি এমনটি হয় সেটি হবে দুঃখজনক ঘটনা এবং অনেকটা রাজকীয় দায়মুক্তির মতো।

আমার প্রশ্ন হলো, সরকারি কর্মচারীদের জন্য কেন এই সংবিধান ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থি বিধানটি রাখতে হবে? গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতির বিষয়টি কার্যকর হওয়ার মানে অনেক কিছু। সরকারি কর্মচারীরা এমনিতেই নিজেদের জনগণের সেবক না ভেবে বরং বিশেষ কিছু ভাবেন। তার ওপর এ সুবিধা তাদের আত্মম্ভরিতা আরও বাড়াবে। সরকারি অফিসগুলোতে এমনিতেই সেবার জন্য মানুষকে ঘুরতে হয়। অনেক সময় 'ঘুষ' দিয়ে সেবা আদায় করে নিতে হয়। অথচ সংবিধানের ভাষা যদি তারা বুঝত, তবে নিজেরাই মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকত। 

সরকারি কর্মচারীদের বিদ্যমান মানসিকতার মধ্যে তাদের গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতির বিধান খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকত। আদালত সে বিধান বাতিল করে নিঃসন্দেহে জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারি কর্মচারীরাও এ রায়ের বিষয়টি উপলব্ধি করুক এবং তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব স্মরণ করুক।

আরও পড়ুন

×