অন্যদৃষ্টি
নো ইউটেরাস, নো অপিনিয়ন

সুধীর সাহা
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২২ | ১৪:৪৬
গত পাঁচ বছরে চারটি দেশ- আয়ারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও কলম্বিয়া যখন গর্ভপাত আইন অনেকটাই শিথিল করছিল, তখন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিলেন। সারা পৃথিবীর মুক্তমনা মানুষদের দীর্ঘশ্বাস যেন ভাষা পেয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কণ্ঠে- 'আজ দেশে এক দুঃখের দিন; এ সিদ্ধান্ত কখনোই এ বিষয়ে শেষ কথা হতে পারে না।' সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, 'আজ সুপ্রিম কোর্ট ৫০ বছরের পুরোনো একটি রায়কে শুধু উল্টিয়েই দিলেন না; নাগরিকের অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারকে নির্বাসিত করলেন।'
১৯৭৩ সালে রো বনাম ওয়েড মামলায় জেন রো নামের (ছদ্মনাম) টেক্সাসের এক অবিবাহিতা তরুণী তৃতীয়বারের মতো গর্ভধারণ করেন। টেক্সাসে তখন গর্ভপাতের ব্যাপারটি আইনসিদ্ধ নয়। জেন রো আদালতের দ্বারস্থ হন। সুপ্রিম কোর্ট সেদিন দীর্ঘদিনের আইনি অচলাবস্থা ভেঙে বেরিয়ে এসে রোয়ের গর্ভপাতের পক্ষে রায় দেন। ব্যক্তির প্রয়োজন ছাপিয়ে এ রায় এক বৃহৎ সমষ্টিগত উদযাপনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই ১৯৭৩ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট মতামত দেন, সংবিধানে আলাদা করে গর্ভপাতের অধিকার উল্লিখিত না থাকলেও নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকারের ভিত্তিতে ধারণা করাই যায়- গর্ভপাতের অধিকার নিশ্চয় সংবিধান-স্বীকৃত। অর্ধশতাব্দী পর আমেরিকার সেই সুপ্রিম কোর্ট তাদের আগের প্রজন্মের বিচারপতির স্বচ্ছ যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে নারীদের হাত থেকে গর্ভপাতের রক্ষাকবচটি আইনের মাধ্যমে কেড়ে নিলেন। আরেকবার প্রমাণ হলো- পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি বংশবৃদ্ধি, মানবজন্ম ইত্যাদি স্পর্শকাতর ক্ষমতায়ন বিষয়ে নারীর আধিপত্যকে কখনও স্বীকার করেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন স্পষ্ট হয়েছিল- শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের ফলে সৃষ্ট কোষ বিভাজিত হতে হতে পূর্ণ জীবদেহের রূপ পায়, তখন থেকেই গর্ভপাত নিয়ে গোঁড়ামি শুরু হয়েছিল, যা আজও অব্যাহত।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আমেরিকায় আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলন ক্রমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যাবে। কোনো কোনো দেশের আইন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের এহেন ব্যাখ্যা কাজে লাগিয়ে গর্ভপাতবিরোধী চিন্তাভাবনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবে। বর্তমানে প্রচলিত নানা বৈজ্ঞানিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং প্রয়োগ থাকলে গর্ভপাতের প্রয়োজন হওয়ারই কথা নয়। আমেরিকার মতো পরীক্ষিত গণতান্ত্রিক দেশেও মায়েদের গর্ভপাতের অধিকার খর্ব হওয়ার পর প্রশ্ন উঠছে- পশ্চিমা বিশ্ব কি এবার গ্রেট লিপ ব্যাকওয়ার্ডের পথে? যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩ দশমিক ৬ কোটি ঋতুমতী নারী এ রায়ের ফলে নিজেদের শরীরের স্বায়ত্তশাসন হারালেন। ইউরোপ ও আমেরিকার নানা দেশে সনাতনপন্থি তথা ক্যাথলিকদের গর্ভপাত-বিরোধিতার ধারা আগে থেকেই চলছে। পোল্যান্ড তো ইতোমধ্যে নারীর জন্য নরকই হয়ে উঠেছে। গত জুন মাসের শেষদিকে পোল্যান্ডে মারা যান ইসাবেলা। ভ্রূণের এডওয়ার্ড সিনড্রোম এবং মায়ের সেপসিসের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও তিনি গর্ভপাত করতে পারেননি। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গেছেন, নারী-শরীর একটা ইনকিউবেটর মাত্র। ক্যাথলিক আয়ারল্যান্ডের গর্ভপাত-গোঁড়ামির শিকার হয়ে ২০১২ সালে মারা যান দন্ত চিকিৎসক সবিতা হলপ্পনভর। সে দেশে অনেক টানাপোড়েনের পর অবশেষে ২০১৯ সালে গর্ভপাতবিষয়ক নতুন বিল পাস হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম ১৯২০ সালে গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইন সংস্কার করেছিল। বিংশ শতকের শেষদিকে প্রায় ৯৮ শতাংশ রাষ্ট্রেই গর্ভপাত শর্তসাপেক্ষে আইনি হয়। নৈতিকভাবে নারীর নিজের শরীরের ওপর অধিকার থাকাই বাঞ্ছনীয়, যেহেতু নারী ১০ মাস শিশুকে গর্ভে ধারণ করেন। কখন তিনি মা হবেন, কোন পরিস্থিতিতে মা হবেন না, আদৌ মা হতে চান কিনা- এসব কিছু স্থির করার অধিকার তাঁরই থাকা উচিত। 'নো ইউটেরাস, নো অপিনিয়ন'- নারীবাদের এক সময়ের জনপ্রিয় স্লোগান। অপেক্ষাকৃত কম কট্টরপন্থিরা বলেন, নারী এবং বড়জোর তাঁর পুরুষ সঙ্গীটির অধিকার থাকুক ভ্রূণের জন্মদান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। নৈতিক প্রশ্নের বাইরেও বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক সময় গর্ভপাত জরুরি হয়ে পড়ে। কখনও ভ্রূণ ও মায়ের স্বাস্থ্য জীবনের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কখনও গর্ভাবস্থা যৌন নিগ্রহের ফল হতে পারে, যা সবার কাছেই অনভিপ্রেত।
সুধীর সাহা: কলাম লেখক
[email protected]
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- সুধীর সাহা