জ্বালানি
পারমাণবিক বিদ্যুৎ যে কারণে জরুরি

সবুজ ইউনুস
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:৩২
গত বুধবার পাবনার ঈশ্বরদীতে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল তথা পারমাণবিক চুল্লিপাত্র স্থাপন কাজের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রথম ইউনিটের প্রেশার ভেসেল স্থাপিত হয়েছিল। আমরা জানি, রিঅ্যাক্টর স্থাপন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যে কারণে রিঅ্যাক্টর ভেসেলকে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের 'হৃদয়' বলা হয়। দ্বিতীয় ইউনিটের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।
ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে; ১৯৬১ সালে। তখন পদ্মা নদীতীরবর্তী এলাকায় ২৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৬৯-৭০ সালে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকারই বাতিল করে দেয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু নতুন করে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তী সরকারগুলো এ নিয়ে আর অগ্রসর হয়নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী ইশতেহারেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল।
তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আমরা যাঁরা লেখালেখি করি, তখন বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। প্রশ্ন জেগেছিল- একটি ঘনবসতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কতটা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে? নতুন করে বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে না তো! এখন রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল স্থাপন কাজের মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুতের সে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বড় ধরনের কোনো সমস্যা না হলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট অর্থাৎ ১২শ মেগাওয়াট আগামী বছরের শেষ নাগাদ জাতীয় গ্রিডে চলে আসার কথা। দ্বিতীয় ইউনিট আসার কথা পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের শেষদিকে। তবে সংশয় আছে, সঞ্চালন লাইন নির্মাণ যথাসময়ে হবে কিনা। সঞ্চালন লাইনের অভাবে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি বন্ধ থাকে তাহলে এটা হবে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্য, পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরো বিদ্যুৎ শুধু সঞ্চালন লাইনের অভাবে যথাসময়ে গ্রিডে আনা যায়নি। এবারও সে রকম আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বিষয়টি অবশ্যই ভালোভাবে তদারকি করা উচিত সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের।
আমরা জানি, বিশ্বে এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিনটি বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। সর্বশেষ অঘটন ঘটেছে জাপানের ফুকুশিমাতে, ১০ বছর আগে। পরমাণুর তেজস্ট্ক্রিয়তা অত্যন্ত ভয়াবহ। ক্ষয়-ক্ষতি হয় নির্বিচারে। বছরের পর বছর বিষময় পরিবেশ বিরাজ করে। সে জন্য সাধারণ মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকেই। যে কারণে চলতি শতকের প্রথমদিক থেকেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি বিশ্বের আগ্রহ কমে আসছিল। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল উন্নত বিশ্ব। ঠিক সেই সময়ে বিশাল ব্যয়ে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করায় সমালোচনা শুরু হয়। প্রসঙ্গত, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর উপযোগিতা এখন বোঝা যাচ্ছে।
বলে রাখা যেতে পারে, ইউরোপের 'পরিবেশ সচেতন' অনেক দেশই এখন বন্ধ পারমাণবিক ও কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার চালু করেছে। কারণ রাশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় গ্যাস তারা পাচ্ছে না। তা ছাড়া গ্যাসের চেয়ে কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন খরচ কম। যদিও কয়লাতে পরিবেশের ক্ষতি বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা চিন্তা করেও বর্তমানে বিশ্বে যেসব নবায়নযোগ্য শক্তির ওপরে জোর দেওয়া হচ্ছে; পারমাণবিক শক্তি তার অন্যতম।
গ্যাসের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল থাকায় বাংলাদেশও বিপাকে পড়েছে ব্যাপকভাবে। একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎই উৎপাদন হতো গ্যাস দিয়ে। তখন গ্যাসের উৎপাদন ছিল অনেক। ফলে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। চলতি শতকের প্রথম থেকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়, গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে আসছে। ফলে বিকল্প জ্বালানির দিকে যেতে হবে। তখন থেকেই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে থাকে। এখন অবশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তার পরও বর্তমানে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে গ্যাস দিয়ে। বাকি অন্যান্য জ্বালানি। মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে বহুমুখী জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ ছাড়া পানি, ফার্নেস অয়েল, ডিজেল, কয়লা, সৌর, বায়ুসহ নানামুখী জ্বালানির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে।
একটা হিসাব দিই। আমাদের কাপ্তাইয়ে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। এটা সারাবছরই প্রায় বন্ধ থাকে। কারণ কাপ্তাই হ্রদে পানি থাকে না। ফলে এটার হিসাব ধর্তব্য নয়। গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে খরচ পড়ে ৩ টাকা ১৩ পয়সা। এর পরই পারমাণবিক বিদ্যুৎ। এখানে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ পড়ে ৪ টাকা ৩০ পয়সা। কয়লায় খরচ ১০ টাকা ৩১ পয়সা, সৌরবিদ্যুতে খরচ ১৫ টাকা, ফার্নেস অয়েলে ১৬ টাকা, ডিজেলে ২৮ টাকা। এক লাখ কেজি কয়লা দিয়ে যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, শুধু এক কেজি পরমাণু জ্বালানি বা ইউরেনিয়াম দিয়ে সে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ খরচ বেশি হলেও এর আয়ু দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ। সাধারণত গ্যাস বা কয়লাচালিত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ুস্কাল ধরা হয় ২০-২৫ বছর; সেখানে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সর্বনিম্ন আয়ু ধরা হয় ৫০ বছর। ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এ কেন্দ্র থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে- এটা সত্য। কিন্তু আমার জানামতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরের প্রযুক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সরকার পারমাণবিক নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। বর্তমান সরকার রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, তাতে ভিভিইআর টাইপ রিঅ্যাক্টর পরিবারের সর্বশেষ সংস্করণ স্থাপনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। ওই প্রযুক্তিতে রাশিয়ান ফেডারেশনের উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক যে কোনো পারমাণবিক নিরাপত্তামূলক বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকবে। ফলে রিঅ্যাক্টরটি মনুষ্যসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যে কোনো দুর্ঘটনা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম থাকবে।
এর পরও আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে সঞ্চালন অবকাঠামো বেশ দুর্বল। জাতীয় গ্রিড অটোমেশন হয়নি। অর্থাৎ স্মার্ট গ্রিড বা স্বয়ংক্রিয় গ্রিড না। গ্রিডের ফ্রিকোয়েন্সি হেভি ফ্লাকচুয়েশনের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অপারেটর তৈরি করা, ফুয়েল হ্যান্ডলিং, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টও বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রয়োজন। এগুলোর জন্য রেগুলেটর বডিতে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের সুদক্ষ হতে হবে।
সব শেষে বলি, বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসার প্রবণতা যেমন আছে, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে পরমাণুকে তেল-কয়লার মতো ফসিল ফুয়েলের বিকল্প জ্বালানি হিসেবেও দেখছে অনেক দেশ। বর্তমানে ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশগুলোয়, যার একটি বাংলাদেশ। যাত্রা শুভ হোক!
সবুজ ইউনুস: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল