ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি

একজন প্রাজ্ঞজনের কথা

একজন প্রাজ্ঞজনের কথা

মাসুদ রানা

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০

অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন জীবিতকালে কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন না। তবে একজন আদর্শবাদী শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, তিনি ঠিক তা-ই ছিলেন। মননশীল প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি বহু সফল অনুবাদও করেছেন তিনি। তাঁর রচিত ও অনূদিত বইগুলো হলো- প্রবন্ধ :গ্রিক দর্শনের রূপরেখা (২০০৭), আরও কয়েকজন সক্রেটিস (২০০৮), অনুবাদ :জর্জ টমসনের 'মার্কসবাদ ও কবিতা' (১৯৮৬), আলফ্রেড গিয়োমের 'ইসলাম' (১৯৯৭), টমাস হার্ডির 'দ্য মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ (২০০৩) এবং সুব্রত কুমার দাসের সঙ্গে Ôkazi Nazrul Islam : Speeches , আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ : পাতা উল্টাই (২০১০)। তাঁর মৃত্যুর পর সাহিত্য সমালোচক সুব্রত কুমার দাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলো মলাটবন্দি করেছেন। বইটির নাম 'অগ্রন্থিত মোজাফফর হোসেন'।
মোজাফফর হোসেন ২০ মে ১৯৩৬ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর(১৯৬১) সম্পন্ন করে পেশা হিসেবে কলেজ শিক্ষকতাকে বেছে নেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরের সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। চাকরির শেষ পর্যায়ে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার পর থেকেই তিনি লেখালেখি আর চিন্তাচর্চা করে জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়ে দেন।
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে ও পরে নিভৃতে বহমান ছিল তাঁর অধ্যয়ন, লেখালেখি আর অনুবাদের কাজ। তিনি একজন সংগীতজ্ঞও ছিলেন। তিনি নিয়মিত সংগীত চর্চা করতেন। সংগীতের অনেক দুষ্প্রাপ্য গানের ক্যাসেট তাঁর সংগ্রহে ছিল।
আমাদের ইতিহাসের ব্রিটিশ উপনিবেশ পর্বে, পাকিস্তান পর্বে এবং বাংলাদেশ পর্বে দেখা যায় অনেক ব্যক্তির চিন্তা-চেতনার উত্থান-পতনের ঘটনা। ভারতবর্ষে যাঁর হাত দিয়ে প্রবাসে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল, সেই এম এন রায়ের মার্কসীয় দর্শন থেকে সরে আসার ঘটনা আমরা সবাই কমবেশি জানি। আর নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পর আমাদের দেশের বহু ত্যাগী বামপন্থি নেতৃত্বের পশ্চাৎপসরণের ঘটনাবলিও করুণভাবে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু মোজাফফর হোসেন জীবনের কোনো পর্যায়েই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকার পরও তাঁর মধ্যে মার্কসীয় রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে নূ্যনতম সন্দেহ, হতাশাবোধ কাজ করেনি। এই রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গেই তাঁর চিন্তাভাবনা একাত্মতা ছিল। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ।
মোজাফফর হোসেন বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ ও লিটারেরি রিসোর্স সেন্টার উভয় সংগঠনেরই সভাপতি ছিলেন।
উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁ নিয়ে বহু তর্কবিতর্কের পরেও বলব, এ ঘটনা যাঁদের মাধ্যমে ঘটেছিল তাঁরা বিদ্বৎ সমাজের কান্ডারি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে। পরবর্তীকালে মুসলিম সমাজের শিখা গোষ্ঠীর কর্ণধার কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখ তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা আজও আমাদের কাছে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করছে। আমার বিবেচনায় মোজাফফর হোসেন তাঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করতেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক 'আজকের কাগজ'-এ তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। তাতে তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্যাগুলো সূক্ষ্ণভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করতেন।
মোজাফফর হোসেন সম্পর্কে সাহিত্য সমালোচক সুব্রত কুমার দাস একটি মন্তব্য করেছিলেন; সেটি যথার্থ বিবেচনা করে এখানে তুলে ধরা যায়। তিনি বলেছিলেন, 'ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রচলিত ঘরানায় মোজাফফর হোসেন ছিলেন না। কিন্তু অদ্ভুত, তিনি ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কোরআন-হাদিসের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর দখল ছিল রীতিমতো ঈর্ষণীয়। বেদ-উপনিষদ-গৌতম বুদ্ধ-বাইবেল সম্পর্কে তাঁর শ্রদ্ধান্বিত বিশ্নেষণ ছিল অনুকরণীয়।'
মোজাফফর হোসেন দর্শনের শিক্ষক হলেও সমাজ, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বের ওপর তাঁর ব্যাপক জানাশোনা এবং পড়াশোনা ছিল। তিনি যথার্থই ছিলেন একজন ইহজাগতিক ও যুক্তিবাদী মানুষ।
পার্থিব ও পারলৌকিক জগতের বিষয়গুলো কোনোভাবেই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আগেই বলা হয়েছে, সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্নিষ্টতা না থাকলেও তাঁর মার্কসীয় রাজনীতির প্রতি আস্থা ছিল শতভাগ। তিনি মানব মুক্তির মতবাদ হিসেবে মার্কসবাদের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন আমৃত্যু। বিশ্বাসী ছিলেন বিজ্ঞানের কার্যকারণ সূত্রের, জীবন চর্চায় সঙ্গী করে নিয়েছিলেন দর্শনের যুক্তিবাদকে। এমন একজন সম্পন্ন ও আলোকিত মানুষ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি ঢাকায় ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
মাসুদ রানা :সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×