ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শীত ও আর্ত

শীত ও আর্ত

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ২২:১৮

এই বৎসর ঋতুচক্রের নিয়ম অনুসরণ করিয়া পৌষের সূচনালগ্নেই শীতকালের আগমন ঘটে নাই। কিন্তু মাসটির মধ্যবর্তী পর্যায়ে যখন আসিয়াছে, বিলম্বের মাশুল যেন পোষাইয়া দিতেছে উহার তীব্রতা দিয়া। উত্তরবঙ্গে তো বটেই, খোদ রাজধানীতেও জাঁকিয়া বসিয়াছে হিম ও কুয়াশা। আবহাওয়া অধিদপ্তরকে উদ্ৃব্দত করিয়া রবিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে- পৌষ অতিক্রম করিয়া মাঘের শেষাবধি থাকিতে পারে শীতের রুদ্র রূপ। অর্থাৎ এই বৎসর প্রকৃতির নিয়ম মানিয়া পৌষ ও মাঘ- দুই মাসই শীত অবস্থান করিবে দাপটের সহিত; বিগত কয়েক বৎসরে যাহা প্রায় বিরল হইয়া পড়িয়াছিল।

ঋতুচক্রের এই স্বাভাবিকতায় সন্তোষের যথেষ্ট কারণ থাকিলেও, দুঃখজনকভাবে জনজীবনে স্বস্তি মিলিতেছে না। রবিবারই সমকালের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, গত কয়েক দিনের তীব্র শীতের কারণে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, তৎসহিত রাজধানীতে বিশেষ করিয়া দিবসের উপার্জনেই নিশি উতরানো শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হইয়া পড়িয়াছেন। যাঁহারা রিকশা চালাইয়া সংসার চালান; শীতের প্রকোপে তাঁহারা হয় রিকশা বন্ধ করিয়া গৃহে পা গুটাইয়া থাকিতে বাধ্য হইতেছেন, নতুবা প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনের পূর্বেই গৃহে ফিরিতেছেন। ফেরিওয়ালা ফেরি করিয়া পণ্য বিক্রয় করিতে পারিতেছেন না। দিনমজুরদিগকেও গৃহে কর্মহীন সময় কাটাইতে হইতেছে। এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই অনেক শ্রমজীবী পরিবারে উনানে পাত্র চড়ানো দুরূহ হইয়া পড়িয়াছে। আরও দুঃখজনক, এই সকল মানুষের দুর্ভোগের আশু সমাপ্তি হইতেছে না। উপযুক্ত শীতবস্ত্রের অভাবে তাহাদিগের পক্ষে শীত নিবারণ কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। বিগত বৎসরগুলিতে সরকারি উদ্যোগে শীতার্ত মানুষদিগের মধ্যে বিশেষ করিয়া কম্বল বিতরণ করা হইলেও, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সমকালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এই বৎসর অদ্যাবধি উহা ক্রয় করিতেই পারেনি। অন্যান্য বৎসর এই সময়ে বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বিভিন্ন উৎস হইতে শীতবস্ত্র সংগ্রহ করিয়া বঞ্চিত দরিদ্র মানুষদিগের মধ্যে বিতরণ করিতে দেখা যাইত। এই বৎসর সেই দৃশ্য গোচরীভূত নহে।

এই দিকে, শুক্রবার সমকালে সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে, শীতের প্রকোপে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করিয়া বয়স্ক ও শিশুদিগের মধ্যে মারাত্মক নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটিতেছে এবং উহার মাত্রা এতটাই; রোগীর স্রোত মোকাবিলায় হাসপাতালগুলিও হিমশিম খাইতেছে। এমনকি রংপুরসহ বহু স্থানে হাসপাতালে রোগীদিগের জন্য শয্যাও মিলিতেছে না। বলা বাহুল্য, এই ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর অধিকাংশ দরিদ্র শ্রেণির। শীতের দংশন তাহাদিগের শরীরেই বসে বেশি। কারণ উপরে যেমনটা বলা হইয়াছে, শীত নিবারণের উপকরণ হইতে এই শ্রেণির মানুষই বেশি বঞ্চিত থাকেন। তিন বেলা অন্ন সংস্থানই দুরূহ; পর্যাপ্ত পুষ্টি এই শ্রেণির মানুষের নিকট অনেকাংশেই স্বপ্ন। ফলে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে অন্য যে কোনো মৌসুমি রোগের মতো ঠান্ডাজনিত রোগও উহাদিগকে কাবু করে বেশি। প্রসঙ্গত, শুধু শীত নহে; প্রচণ্ড গরম ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এই হতভাগ্য মানুষদিগেরই বিপন্ন দশা বেশি দৃশ্যমান।

প্রশ্ন হইল, পৌষ মাসের শেষদিকে সাধারণত শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়- ইহা নবতর কোনো অভিজ্ঞতা নহে। এমন প্রশ্ন কি অসংগত- সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদিগের শৈত্যাঘাত হইতে রক্ষার করিতে সরকার যথাসময়ে কম্বল ক্রয় করিল না কেন? হয়তো সরকারি ক্রয়কার্যে চিরাচরিত আমলাতন্ত্রের লালফিতার দৌরাত্ম্যের উপর দায় চাপাইয়া প্রশ্নটার যথার্থ উত্তর পরিহারের চেষ্টা চলিতে পারে। কিন্তু ইহাতে যে সমাজের দরিদ্র মানুষদিগের প্রতি আমাদের শাসককুলের চিরাচরিত ঔদাসীন্যও পরিস্ম্ফুট- উহাও অস্বীকার করা যাইবে না। না হইলে, সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা অন্তত অর্থ বা খাদ্যসামগ্রী লইয়া কর্মহীন শীতে আড়ষ্ট পরিবারসমূহের দ্বারপানে ধাবিত হইতেন। ঠান্ডাজনিত রোগের চিকিৎসায় প্রয়োজন অনুসারে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইত। যাহা হউক, সকল ভালো তাহার, শেষ ভালো যাহার- এই প্রবাদবাক্য স্মরণ করিয়া সরকার অনতিবিলম্বে সকল প্রকার সহায়তা লইয়া ঐ শীতার্ত মানুষদিগের পার্শ্বে দাঁড়াইবে বলিয়া আমরা মনে করি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাইয়াছে, শুধু এই মাসেই নহে; আগামী মাসেও একাধিক শৈত্যপ্রবাহ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহিয়া যাইতে পারে। আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ হইতে এখনই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ জরুরি বলিয়া আমরা মনে করি।

আরও পড়ুন

×