ভেকছত্র

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৩:২১
রাজধানী ঘিরিয়া আবাসন প্রকল্পের নামে যাহা চলিতেছে, যেই কোনো বিচারেই উহা অরাজকতার নামান্তর। শনিবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাইতেছে- কেরানীগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় দুই শতাধিক বেসরকারি আবাসন প্রকল্প গড়িয়া উঠিয়াছে; যেগুলি কয়েক বৎসর পূর্বেও ছিল নিখাদ কৃষিজমি, জলাশয় কিংবা বনবাদাড়। ঢাকা মহানগরের পরিকল্পিত বিকাশ ও নাগরিক সুবিধা সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ অনুসারে ঐ সকল এলাকায় আবাসন প্রকল্প সম্পূর্ণ অবৈধ। স্বাভাবিকভাবেই এই সকল প্রকল্প রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের ভূমি উন্নয়ন ও নির্মাণকাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের অনুমোদন পায় নাই; কিন্তু তদসত্ত্বেও তথাকার প্লট বিক্রয় থামিয়া নাই; বরং কোনো কোনো প্রকল্প অবৈধভাবে হইলেও ভবনও উঠিয়াছে। ইহার ফলে, প্রতিবেদনমতে- যে জমির মূল্য কিছুদিন পূর্বেও ছিল প্রতি কাঠা ৪-৫ লক্ষ টাকা, উহাই বর্তমানে বিক্রয় হইতেছে ২০-২৫ লক্ষ এমনকি ৫০ লক্ষ টাকায়। উল্লেখ্য, এই অবৈধ আবাসন প্রকল্পসমূহে অতি উচ্চমূল্যে প্লট ক্রয় করিয়া শুধু ক্রেতারাই ঠকিতেছেন না, জমির মূল মালিকেরাও- যাহারা অনিবার্যভাবে ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ- নানা প্রতারণার শিকার হইতেছেন। অভিযোগ রহিয়াছে, অনেক প্রকল্পেই জমি ভাড়া লইয়া তথায় আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড বসাইয়া দেওয়া হয়; প্লট বিক্রয়ের সময় মূল মালিককে সামান্য অর্থ ধরাইয়া দিয়া প্লট ক্রেতার অনুকূলে নিবন্ধন দিতে বাধ্য করা হয়।
দুঃখজনক হইল, বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া তাহাদের একেবারে দৃষ্টির সম্মুখে এই সকল ঠকবাজি চলিলেও রাজউক কর্তৃপক্ষ উহা বন্ধে জোরদার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। অনস্বীকার্য, উক্ত আবাসন প্রকল্পসমূহের মালিকেরা রাজউকের অনুমোদন না পাইয়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার অনুমোদন লইয়া গ্রাহক ঠকাইবার কার্যটি চালাইয়া যাইতেছেন। কিন্তু ইহাও সত্য, সংশ্নিষ্ট স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহকে উহাদের এখতিয়ারবহির্ভূত এহেন কাজ না করিবার পরামর্শসংবলিত পত্র প্রদান করিয়াই রাজউক উহার দায়িত্ব সমাপ্ত করিয়াছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে- বিশেষত যথায় নানা প্রয়োজনে জনগণকে যাইতে হয়- দুর্ভাগ্যজনকভাবে যেই প্রকারে প্রায় বল্কগ্দাহীন হয়রানিমূলক কর্মসংস্কৃতি গড়িয়া উঠিয়াছে এবং উহার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসাবে ঘুষ-দুর্নীতি বাসা বাঁধিয়াছে, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে এইরূপ সংশয়ও উড়াইয়া দেওয়া যায় না যে, রাজউকের ঐ নির্লিপ্ততার পশ্চাতে উক্ত অবৈধ আবাসন ব্যবসায়ীদের সহিত সংস্থাটির অসাধু কর্মকর্তাদের কোনো প্রকার অশুভ আঁতাত থাকিতে পারে। ইহাও অজানা নহে যে, আবাসন ব্যবসায়ীরূপী এই সকল প্রতারকেরা- ক্ষমতায় যে সরকারই থাকুক- বরাবরই রাজনৈতিকভাবে বিশাল প্রভাব ভোগ করে; ফলে এহেন প্রতারণা প্রতিরোধে রাষ্ট্রে একাধিক সংস্থা থাকিলেও কেহই উহাদের ঘাঁটাইতে সাহস করে না।
আমরা জানি, পরিবেশ ও মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময় এই প্রকারের অবৈধ আবাসন প্রকল্পের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়াছিলেন; কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা হয় কার্যকর হয় নাই অথবা নামকাওয়াস্তে কার্যকর হইয়াছে। প্রশ্ন উঠিতে পারে, ক্রেতারাই বা কেন এতকিছু জানিয়া-শুনিয়া ভূমিদস্যুদের ফাঁদে পা দিতেছেন? উত্তরটা হতাশাজনক হইলেও অনেকেরই জানা; অদ্যাবধি যত সরকার দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হইয়াছে, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে উহাদের সকলেই উন্নয়ন ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য এমন নীতি অনুসরণ করিয়াছে, যাহার কেন্দ্রবিন্দু হইল রাজধানী। ফলে প্রশাসনিক প্রয়োজনে তো বটেই, শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক সেবার জন্যও একটু সামর্থ্যবান মানুষকে দেশের বিভিন্ন অংশ হইতে এই নগরীতে ছুটিয়া আসিতে হয়। একই কারণে কর্মসংস্থানের প্রশ্ন উঠিলেও ঢাকাই থাকিবে সকলের শীর্ষে। ফলে জনসাধারণের বিপুল সংখ্যকের মধ্যে যেই কোনো উপায়ে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে না হউক, প্রান্তবর্তী স্থলে হইলেও মাথা গুঁজিবার ঠাঁই খুঁজিবার প্রবণতা গড়িয়া উঠিয়াছে। আর উহাকেই পুঁজি করিয়া যেই কোনো উপায়ে অল্প সময়ে এবং অল্প পরিশ্রমে ধনী হইতে ইচ্ছুক চক্রসমূহ রাজধানীর চারিপার্শ্বে ভেকছত্রের ন্যায় আবাসন প্রকল্প ফাঁদিতেছে।
নিরীহ ক্রেতাদের বাঁচাইবার স্বার্থে তো বটেই; ইতোমধ্যে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালিত সমীক্ষায় বিশ্বের অন্যতম বসবাস অযোগ্য শহর বলিয়া পরিচিতি পাওয়া ঢাকাকে বাসযোগ্য করিবার নিমিত্তেও অবিলম্বে ঐ সকল অবৈধ আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।