ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

আফগান তরুণীর দেয়াল লিখন

আফগান তরুণীর দেয়াল লিখন

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২২:২৭

'ওকে পড়তে দাও- লেট হার লার্ন'। কাবুল শহরের বড় রাস্তার মোড়ে দেয়ালে মোটা কালো হরফে লিখেছে মেয়েটি এমন একটি স্লোগান। এর পর মেয়েটি অঝোরে কেঁদেছে। শিক্ষার দাবিতে কাবুলে দেয়াল লিখছে- এমন এক তরুণীর ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি আফগান মেয়েদের ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটির তালেবান সরকার। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেও মেয়েদের কাজ করা নিষিদ্ধ। জাতিসংঘ এতে উদ্বিগ্ন। তারা বিবৃতি দিয়েছে- আফগানিস্তানে এখন যা পরিস্থিতি, তাতে লাখ লাখ মানুষের মানবিক ও মানসিক সাহায্য দরকার। এটা তাদের বাধা তৈরি করার সময় নয়; বরং বাঁধ ভাঙার সময়। তালেবানের দাবি- স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোতে ইসলামী প্রথা মেনে পোশাক পরছিল না অনেকে। ফলে পরবর্তী নোটিশ জারির আগ পর্যন্ত ওই সংস্থাগুলোতে নারী কর্মীদের কাজ করতে দেওয়া হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা মেয়েদের জন্য বন্ধ; স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করা নিষিদ্ধ; নিষিদ্ধ মেয়েদের চাকরি, কর্মসংস্থানের অধিকার; বন্ধ মেয়েদের রাস্তায় জমায়েত-মিছিল। এর মধ্যেই ক্রন্দনরত মেয়েটির ছবি ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বড় বড় রাষ্ট্রনায়কের কেউ কেউ নিন্দা জানিয়েছেন; কেউ আফসোস করেছেন। আবার কেউবা নির্লিপ্ত। নিন্দা করে দায় সেরেছে জাতিসংঘও। কিন্তু তাতে আফগানিস্তানের অসহায় মেয়েদের মুক্তির ঠিকানা মিলছে না। একে তো সেখানকার অর্থনীতি তলানিতে; খাদ্য-স্বাস্থ্য-চিকিৎসার নূ্যনতম পরিষেবারও অভাব। এর মধ্যে মেয়েদের ঘরবন্দি করে রাখার পরিকল্পনা।

গত দুই দশক ধরে আফগান মেয়েদের মধ্যে যাঁরা সাংবাদিকতা, খেলাধুলা, সংস্কৃতির মধ্যে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন; এবার তাঁদের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে পুরোপুরি। তাঁদের মুখের ওপর সব দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ঠিক দুই দশক আগের অবস্থায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ ১০০ বছর আগেও এমনটি ছিল না আফগানিস্তানে। রাজা আমানুল্লাহ খানের স্ত্রী রানী সোরাইয়ার হাত ধরে আফগানের মেয়েরা তখন পর্দাপ্রথা থেকে বের হয়ে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ-সমাজ গঠন কাজে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ ও ছেলেদের ২১ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমানুল্লাহ। তবে সেদিনও তাঁরা শেষ রক্ষা করতে পারেননি। রাজা-রানী দু'জনকেই ১০ বছরের জন্য নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। আফগান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা আবদুর রহমানের বড় ছেলে হাবিবুল্লাহকে মেয়েদের কলেজ এবং ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল প্রতিষ্ঠার অপরাধে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ১৯১৯ সালে তাঁকে হত্যা করে আঞ্চলিক নেতারা। এর পরও আফগান মেয়েদের উন্নয়ন থেমে থাকেনি। আমানুল্লাহর নির্বাসনের পর আফগান মেয়েদের ক্ষমতায়নে বিস্তর কাজ করেছিলেন রাজা জহির শাহ। ১৯৩৩-'৭৩ তাঁর এ দীর্ঘমেয়াদি শাসনকালে প্রচুর নারী চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষক তৈরি হয়েছিলেন আফগানিস্তানে। ওই সময় মেয়েরা রাজনীতিতেও অংশীদারিত্ব রক্ষা করেছিলেন। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময় চিকিৎসাশাস্ত্র, বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে ছাত্রীদের জন্য পৃথক শাখা খোলা হয়েছিল।

১৯৭৯ সালে শুরু হয় আফগান মেয়েদের কালো দিনের সূচনা। পরবর্তী সময়ে নারীদের স্বাধীনতা লঙ্ঘন, তাঁদের ওপর দমনপীড়নকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তালেবান গোষ্ঠী। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার আফগানিস্তান দখলের পর নারীদের পায়ের গোড়ালির অংশ দেখা গেলে; হিজাব থেকে কোনো চুল উড়লে শাস্তিস্বরূপ প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত জুটত। পাপ আরও গুরুতর মনে করলে আফগান নারীদের অবিরত পাথর ছুড়ে হত্যা করা হতো। দ্বিতীয়বার এসে তালেবান তাদের ভূমিকার পুনরাবৃত্তিই করছে বর্তমানে।

'পড়াশোনা বন্ধ, চাকরি বন্ধ; ঘরে থাকো মেয়েরা, গৃহস্থালি কাজ করো- সন্তান জন্ম দাও। খবরদার, রাস্তায় বেরুবে না; দাবি জানাতে মিছিলে যোগ দেবে না'- আফগানিস্তানের নতুন তালেবান সরকার এ কথা জানিয়ে দিয়েছে সে দেশের মেয়েদের। কাবুলের যে মেয়েটি দেয়ালে লিখল 'ওকে পড়তে দাও- লেট হার লার্ন'; তার ছবি কি দেখল বিশ্ববাসী? আজ অথবা কাল আমরা কি প্রস্তুত আফগান সেই তরুণীর দেয়াল লিখনের উত্তর দিতে?

সুধীর সাহা: কলাম লেখক

আরও পড়ুন

×