প্রতিবেশ
বন্যপ্রাণীর এতিম বাচ্চারা কোথায় যাবে?

পাভেল পার্থ
প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০
গত ৭ এপ্রিল রাতে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সড়কে চশমাপরা হনুমানের এক বাচ্চার আর্ত চিৎকার করতে দেখেন স্থানীয়রা, পাশে পড়ে ছিল বিদ্যুৎস্পর্শে মৃত মায়ের লাশ। গত বছর ১ অক্টোবরে একই স্থানে বিদ্যুৎস্পর্শে আরেকটি চশমাপরা হনুমান মারা যায়। চলতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি দিলখোশ চা বাগানের সড়কে বিদ্যুৎস্পর্শে মারা যায় আরেক চশমাপরা হনুমানের বাচ্চা। বিদ্যুৎস্পর্শ বা সড়ক দুর্ঘটনায় এর আগেও দেশে বেঘোরে মারা গেছে বুনোপ্রাণ। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে সেসব করুণ মৃত্যুর খবর কমই প্রকাশ পেত। এখন দুর্ঘটনায় শুধু মানুষ নয়; প্রকাশ পাচ্ছে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর খবরও। সর্বশেষ অঘটনটি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম– ‘বিদ্যুৎস্পর্শে চশমাপরা হনুমানের মৃত্যু, হাউমাউ করে কাঁদছে শাবক’ (সমকাল, ৮ এপ্রিল ২০২৩)।
এই চশমাপরা হনুমান আজ বাংলাদেশে মহাবিপন্ন এবং দুনিয়াজুড়ে বিপন্ন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও যুক্তরাজ্যের র্যাফর্ড ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ২০১৮-১৯ সালে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বনে চশমাপরা হনুমান নিয়ে একটি জরিপ হয়। জরিপে ৫টি বনে ৩৬টি ভিন্ন দলে মোট ৩৭৬টি চশমাপরা হনুমান পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকরা। ১৯৮২ সালের একটি গবেষণায় দেশে ১৩শ চশমাপরা হনুমানের কথা জানা যায়। ১৯৮৪ সালের আরেক গবেষণায় সেই সংখ্যা কমে হয় ১ হাজার ৫০। আইইউসিএন ২০০৮ সালে চশমাপরা হনুমানকে দুনিয়াব্যাপী বিপন্ন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং ২০১৫ সালে লাল তালিকা বইতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে উল্লেখ করে। উক্ত গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ’১৯ সাল পর্যন্ত লাউয়াছড়া, সাতছড়ি ও পাথারিয়া বনে অন্য প্রাণীর পাশাপাশি বিদ্যুৎস্পর্শে আটটি চশমাপরা হনুমান মারা যায়।
বিদ্যুৎস্পর্শে বারবার যেখানে মরছে চশমাপরা হনুমান, সেই লাঠিটিলা পৃথিবীর খুব গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল। পর্যটনপ্রিয় অনেকের কাছে লাউয়াছড়া, মধুপুর বা সুন্দরবনের মতো পরিচিত নয়; কিন্তু এটি ‘ইন্দো-বার্মা প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ অঞ্চল’-এর অংশ।
জুড়ী রেঞ্জের লাঠিটিলা বিট প্রাকৃতিকভাবে খুব নাজুক এলাকা। সেখানে যখন সড়ক তৈরি হলো এবং বিদ্যুতের লাইন বসল তখন থেকেই বিশেষ করে বন্যপ্রাণীর নানামুখী বিপদ হতে থাকল। গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে বা বিদ্যুৎস্পর্শে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর পরিসংখ্যান দীর্ঘ হতে থাকল।
লাঠিটিলাসহ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বিদ্যুৎস্পর্শ, সড়ক দুর্ঘটনা, পিটিয়ে বা বিষ দিয়ে বন্যপ্রাণী হত্যার পূর্ণাঙ্গ কোনো খতিয়ান এখনও আমাদের হাতে নেই। নিহত বন্যপ্রাণীর এতিম বাচ্চাগুলোর সর্বশেষ পরিণতি কী হয়, আমরা জানি না। কিছু হয়তো লড়াই করে আবারও বুনো পরিবেশে টিকে যায়। বাকিদের কী হয়? বিদ্যুৎস্পর্শ বা সড়ক দুর্ঘটনা বা বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ যেমন জরুরি; নিহত বন্যপ্রাণীর এতিম বাচ্চার সুরক্ষা তৎপরতাও জরুরি।
শুধু ‘দুর্ঘটনা’ নয়; মানুষও নৃশংসভাবে বন্যপ্রাণী হত্যা করে চলছে। সেটা করোনা মহামারিকালে প্রবল লকডাউনের ভেতরও বন্ধ ছিল না। ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের পর মধ্য জুন পর্যন্ত ২৮৮টি বন্যপ্রাণী হত্যা করা হয়েছে। আর বোরো মৌসুমে ধানের জমিনে ফাঁদ-জাল আর বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যা একটা বিচারহীন ‘স্বাভাবিক ব্যাপার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওয়াইল্ডলাইফ জাস্টিস কমিশন ‘অপারেশন ড্রাগন’ নামে বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণীর চোরাচালান নিয়ে ২০১৬ সালে শুরু করা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০২০ সালে। প্রতিবেদনে ঢাকাকে বৈশ্বিক কাছিম ও কচ্ছপ চোরাচালানের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্ঘটনাজনিত বা হত্যা নয়; চোরাচালানের কারণেও খুন হয় অজস্র বন্যপ্রাণী। পাশাপাশি সিলেটের হরিপুরের পাখির হোটেলের মতো নির্দয় রসনাবিলাসের কারণেও মৃত্যু হয় বুনোপাখির। কথা হলো, এসব বুনোপ্রাণীর বাচ্চা কীভাবে বড় হয়?
যখন একটি বাসা থেকে ডিমে তা দেওয়া পাখি ধরে আনা হয় বা একটা মা সাপকে মেরে ফেলা হয় কিংবা একটা মা হরিণকে খুন করা হয়, তখন সেই এতিম বাচ্চাগুলোর অবস্থা কী হয়? এসব কি আমাদের চিন্তায় আসে?
এতিম বন্যপ্রাণীর ব্যাপারে রাষ্ট্রের তৎপরতা এখনও স্পষ্ট নয়। যদিও আহত ও উদ্ধার করা বন্যপ্রাণী কিছু সময় বন্যপ্রাণী পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা এবং পরে অবমুক্ত করা হয়। লাউয়াছড়া বনের পরিচর্যা কেন্দ্র প্রায়ই উদ্ধারকৃত ও আহত বন্যপ্রাণীর পরিচর্যার কিছু ঘটনা জানা যায়। রাজশাহী বন্যপ্রাণী পরিচর্যা কেন্দ্রে উদ্ধার হওয়া নীলগাই কিংবা দিনাজপুরের সিংড়া শালবনে স্থাপিত শকুন পরিচর্যা কেন্দ্রে কিছু শকুনের পরিচর্যার কথা জানা যায়। পরে এগুলোকে বন্য পরিবেশে অবমুক্ত করা হলে সেই জীবনগুলো কতটা বিপদমুক্ত থাকে, এসব বিষয়ও দেখভাল করা জরুরি।
নিহত বন্যপ্রাণীর বাচ্চার জন্য বন বিভাগ একটি সুস্পষ্ট নীতি পরিকল্পনা করতে পারে। স্থানীয় বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনের যুক্ততা ও তৎপরতাকে আরও সক্রিয়ভাবে বন বিভাগ সামগ্রিক কাজে যুক্ত করতে পারে। এ ছাড়া বন্যপ্রাণীর বৈশিষ্ট্য, ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্য এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা জরুরি।
২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ লরিস রিসার্চ অ্যান্ড কনজারভেশন প্রকল্প’র আওতায় বন বিভাগ লাঠিটিলায় হনুমানসহ বন্যপ্রাণীর নিরাপদ চলাচলের জন্য সড়কের ওপরে ঝুলন্ত ‘ক্যানোপি সেতু’ স্থাপন করেছে। আরও কয়েকটি স্থাপন করার পরিকল্পনা আছে। এখনও বন্যপ্রাণী এই ঝুলন্ত সেতু ব্যবহার করতে সাংস্কৃতিকভাবে অভ্যস্ত হয়নি।
প্রাকৃতিক বনের ভেতর রেললাইন, সড়কপথ কিংবা বিদ্যুৎলাইন অবশ্যই বন্যপ্রাণীর জন্য বিপজ্জনক। এ অবস্থায় দেশের সব বনভূমি ও বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্রগুলোর সামগ্রিক চিত্র সামনে রেখে এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা করা দরকার। লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে যেমন সড়ক ও রেলপথে গতিসীমা সীমিত করা হয়েছে। লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক লাইনে নিরাপদ কাভার লাগানোর জন্য পল্লী বিদ্যুৎকে চিঠি দিয়েছে বন বিভাগ।
আশা করি, বন্যপ্রাণীর প্রতি আমাদের দায় ও দায়িত্ববোধ বিকশিত হবে এবং চশমাপরা হনুমানের এতিম বাচ্চার মতো সব বন্যপ্রাণীর সঙ্গে ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
পাভেল পার্থ : লেখক ও গবেষক