ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

কূটনীতি

ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা অনিবার্য ছিল

ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা অনিবার্য ছিল

ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | ২২:২৭

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উদ্যোগ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল-আইপিএস বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ তার অবস্থান ঘোষণা করেছে। এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্ন থাকবে। আইপিএসে যুক্ত হতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা ২০১৮ সাল থেকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ প্যারিস সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

বাংলাদেশ হঠাৎ তার নীতি পরিবর্তন করেছে, নাকি আগে থেকেই, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, মানুষ ভূ-রাজনীতি বা জিও পলিটিকস তৈরি করে এবং প্রয়োজন হলে পরিবর্তনও করে। ভূ-রাজনীতি কখনও মানুষকে তৈরি করে না। আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে যাই দেখতে পাব, ব্রিটিশরা প্রায় ২০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে। তারা ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নিয়েই এখানে এসেছিল। সে সময়ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে ভারতবর্ষের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই ব্রিটিশদের বিশেষ নজর ছিল এ অঞ্চল ঘিরে। সেই আমলেও চীনের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। চীনের অর্থনীতি হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়নি। এখনকার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, চীনের অর্থনৈতিক পুনরুত্থান হয়েছে। অবিভক্ত ভারত অর্থনৈতিক বিবেচনায় পৃথিবীতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। আগেই বলেছি, ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলার অবস্থান ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই ব্রিটিশরা ঢাকাকে শাসনের নামে ২০০ বছর শোষণ করেছে। বলা যায়, নানা অপকৌশলের জালে আমাদের অর্থনীতি শেষ করে দিয়েছে ওই শাসক চক্র।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এ দেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়; বরং স্বাধীনতার ৫২ বছরে আমাদের দেশ পৃথিবীতে অনেকের কাছে রোল মডেল। সমালোচকরাও এ সত্য অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন। বিভিন্ন জরিপেও দেখা গেছে, তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম ঘুচিয়ে আমরা দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছি। জিডিপি, গড় আয়ু থেকে শুরু করে বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের অগ্রগতি দক্ষিণ এশিয়ায় নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতার কারণে অনেক সময় অন্যান্য দেশ আমাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশ এখন আর ছোট দেশ নয়, তাই বিশ্বের কাছে তার অবস্থান পরিষ্কার থাকা উচিত। সামগ্রিক পরিকল্পনা পরিষ্কার থাকলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চালিয়ে নেওয়া সহজ হয়। এ বিবেচনায় ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল-আইপিএস ঘোষণা হয়েছে বলে মনে করি।

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ সময় সময় তাদের পররাষ্ট্রনীতি তৈরি ও প্রকাশ করে। হোয়াইট পেপার, ব্লু পেপার, গ্রিন পেপার– এসব নামে প্রকাশিত নীতিমালায় নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে। এর মূল উদ্দেশ্য, বিনিয়োগে অন্য দেশকে আকৃষ্ট করা। সন্ত্রাস দমননীতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এক কথায় সামগ্রিক পররাষ্ট্রনীতি পরিষ্কার থাকলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা আস্থা পায়। ফলে সে দেশে সমৃদ্ধি বাড়ে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামগ্রিক উন্নয়ন হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতি আস্থা রাখতে না পারলে কখনোই বিনিয়োগের ঝুঁকি নেবে না। রাজনৈতিক অর্থনীতি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

চার মৌলিক নীতি ও ১৫ লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল-আইপিএস ঘোষণা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে আইপিএস ঘোষণা আলাদা তাৎপর্য বহন করে। এটি হঠাৎ ঘোষণা করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। এটি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা সময় নিয়ে কাজ করেছেন এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশ আইপিএসের মাধ্যমে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এখানে দুটি পয়েন্ট রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ অবাধ ও নিরাপত্তার বিষয়টি পরিষ্কার করেছে। দ্বিতীয়ত, কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে যে নীতি ঠিক করে দিয়েছেন, তা হলো– সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। সুতরাং আমরা এমন কোনো জোটে যাব না, যা কোনো দেশের সঙ্গে বৈরিতা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যে কোনো দেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে– এটি যেমন পরিষ্কার করা হয়েছে; একইভাবে সামরিক জোটের মাধ্যমে কোনো দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ সমর্থন করে না। পদ্মা সেতু, মেট্রারেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী দেশ রয়েছে। তার মানে, বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার।

প্রধানমন্ত্রী এবার তিনটি দেশ সফরকালে বিদেশি বন্ধুদের বলতে পারেন– ব্যবসার জন্য আমাদের জানালা সবার জন্য খোলা। তবে নতুন দেশ বিনিয়োগে যুক্ত হতে গিয়ে অন্য দেশকে বাদ দেওয়ার কথা বলতে পারবে না। আমাদের কাঠামোতে এ সুযোগ নেই। কারণ কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে পুরোনো কোনো বন্ধুকে বাদ দেওয়ার নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে না। এতে বৈরিতা তৈরি হয়। এ দেশ বন্ধুত্বে বিশ্বাস করে, তাই বৈরিতা ডেকে আনা যাবে না। বাংলাদেশ বোঝাতে চেষ্টা করবে, এক দেশের লাভের চিন্তা না করে জোটগতভাবে সবার লাভ নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যই আইপিএস।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে চীন, ভারত, রাশিয়া, আমেরিকা সবার সঙ্গেই সম্পর্ক জোরদার হবে। রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় কৌশলগত কারণে নানা কথা বলে থাকেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা প্রসঙ্গে যেসব কথা এর আগে বলেছেন, তাতে বড় প্রভাব দেখি না। কারণ, আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। ব্যবসা, নিরাপত্তা, শিক্ষার্থী আদান-প্রদানসহ নানা মাত্রায় সম্পর্ক জড়িত। এসব আমেরিকার না বোঝার কারণ নেই। বরং এবার সফরকালে প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান আরও পরিষ্কার করতে পারবেন। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হলে চীনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণ দেখি না। কারণ বাংলাদেশ আইপিএসের মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিয়েছে– দেশটিতে সবার জন্য বিনিয়োগের জানালা খোলা। তবে কাউকে বাদ দিয়ে নিজেকে যুক্ত করার কথা বলার সুযোগ নেই। একই সঙ্গে সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ বিষয়েও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে।

যে কোনো কৌশল তৈরি করার পর তা বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ নিতে হয়। কূটনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানও বের হয়ে আসে। সন্ত্রাসের গতিবিধি কোনো নির্দিষ্ট দেশে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাই প্রতিবেশী দেশসহ অন্যদের সঙ্গে সমঝোতা থাকলে এ সমস্যার সমাধান সহজ হয়। আইপিএস যে লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে, তা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ করে যেতে হবে।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রাক্তন অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×