ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

সরেজমিন

দুটি জনসভা এবং পদাতিক কয়েকটি লোক

দুটি জনসভা এবং পদাতিক কয়েকটি লোক

এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ | ১৯:২৩

ঘড়ির কাঁটায় বেলা ২টা। রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়। মগবাজার থেকে মহাখালী অভিমুখী রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও মহাখালী থেকে পল্টনমুখী রাস্তায় গাড়ি সামনে এগোচ্ছে ধীরে। সাতরাস্তা মোড়ের ভূমি অফিসের সামনের ফুটপাতে দেখা গেল বেশ কিছু প্ল্যাকার্ড। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপি নেতা মো. মহিউদ্দিনের মুক্তির দাবিসংবলিত প্ল্যাকার্ডগুলোতে কাদামাটি লেগে আছে। একটু আগের বৃষ্টি ও পথচারীদের পায়ের ছাপ দেখা গেল। ভূমি অফিসের সামনে অপেক্ষমাণ ভাড়ায় চালিত এক মোটরবাইক চালকের কাছে জানতে চাইলাম, পল্টন যাবেন কিনা? উত্তর এলো, ‘ভাড়াটা বাড়ায়া দিয়েন।’ কথা না বাড়িয়ে তাঁর পেছনে বসে পড়লাম। একটু এগোতেই উড়াল সড়কে ওঠার মুখে পুলিশের ব্যারিকেড। অগত্যা সব গাড়ি উড়াল সড়কের নিচ দিয়ে মগবাজারের দিকে ছুটল।

এরই মাঝে বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা এসে পড়ল। আকাশের দিকে মাথা উঁচু করতে গিয়ে সামনের খোলা ট্রাকে চোখ পড়ল। ট্রাকের সামনে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানার টানানো। খোলা ট্রাকে জনা ত্রিশেক লোক। কয়েকজনের মাথায় ক্যাপ ও ব্যাজ লাগানো। সেখানে দেখা গেল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ছবি। এখান থেকে মিনিট পাঁচেক পরে সামনে চলার মতো সুযোগ তৈরি হলো। সার্কিট হাউস পার হওয়ার পর আর এগোনোর উপায় রইল না। মোটরবাইক চালককে ভাড়া মিটিয়ে কাকরাইল অভিমুখে হাঁটা শুরু করি।

কাকরাইল মোড়ে এসে দেখি পুলিশের চেকপোস্ট। কাকরাইলে বিচারপতিদের বাসভবনের সামনে দাঁড়াতেই দেখা গেল বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। একজনের দিকে এগিয়ে গেলাম। নাম জানালেন– জাকির। এসেছেন রাজধানীর রামপুরা থেকে। একটা চিকন বাঁশের সঙ্গে বিএনপির দলীয় একটি মাঝারি সাইজের পতাকা কাঁধে রেখেছেন। পেশায় রাজমিস্ত্রি। বয়স ৬০। বিএনপির সমাবেশে কেন এসেছেন, জানতে চাইলাম। প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক। বললেন, ‘মনপ্রাণ দিয়ে বিএনপি করি। আসব না ক্যান?’ প্রথমে ভাবলাম, দীর্ঘ সময় রোদে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে আছেন, তাই এভাবে জবাব দিলেন। পরে কিছুটা ধীরস্থির হয়ে বললেন, ‘সাংবাদিকগো লগে কথা কইতে ইচ্ছা করে না। বেশিরভাগই মিথ্যা কথা লেহে।’ এইবার কিছুটা আস্তে করে জানতে চাইলাম, কোনটা মিথ্যা মনে হয়েছে তাঁর কাছে? বললেন, ‘অহন তো আলাদা কইরা কওন যাইব না। তয় আজকা রাতে বাসায় গিয়া টিভি দেখলে আর কালকা পেপারের কাগজ পড়লেই বুঝা যাইব। বিএনপির সমাবেশের লোক দেইখ্যা যান আর ওইহানে আওয়ামী লীগেরটাও গিয়া দেখেন। তারপর নিজেই বিবেচনা কইরেন।’

আওয়ামী লীগের সমাবেশে উপস্থিতি (বামে) দলীয় পতাকা হাতে বিএনপির সমর্থক - সমকাল  

এখান থেকে সামনে এগিয়ে কাকরাইল মোড়ের দিকে এগোতেই শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টিতে রাস্তার দু’পাশে থাকা বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা কিছুটা ছোটাছুটি শুরু করলেন। আশপাশের ভবনের গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে দোকানের শাটারের নিচে আশ্রয় নিতে দেখা গেল অনেককে। কিন্তু মানুষের তুলনায় আচ্ছাদিত স্থানের পরিমাণ কম হওয়ায় এক সময় দেখা গেল, আবার সবাই হইহই করে রাস্তায় নেমে এলেন। এরই মধ্যে দেখা গেল যুবদলের ক্যাপ পরিহিত এক দল ব্যান্ড পার্টি নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই দলীয় এবং সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ভিড়ের মাঝে এক সময় এসে স্কাউট ভবনের সামনে দাঁড়াই। সেখানেই আইসক্রিম বিক্রি করছিলেন মুজাহিদুল নামে একজন। জানালেন, এক ভ্যান আইসক্রিম নিয়ে এসেছিলেন ঘণ্টাখানেক আগে। এরই মধ্যে শেষ।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে যখন এসে দাঁড়াই তখন ঘড়ির কাঁটায় সময় ৩টা ৩৫ মিনিট। কার্যালয়ের সামনে সাতটি ট্রাক দিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চে তখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন এক নেতা। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘যেদিন বিএনপি সমাবেশ ঘোষণা করে, আওয়ামী লীগও একই দিনে সমাবেশ করে কেন?’

মঞ্চে বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে সিনিয়র নেতাদের নাম ঘোষণা চলছিল। সমাবেশ মঞ্চের সামনে দেখা গেল বিভিন্ন রকমের প্ল্যাকার্ড হাতে নেতাকর্মী দাঁড়িয়ে আছেন। এর মাঝে কয়েকটি প্ল্যাকার্ড আবার ইংরেজিতে লেখা। দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করতে বিদেশি কয়েকজন প্রতিনিধি বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন। ইংরেজি প্ল্যাকার্ড দেখে সে কথাই মনে পড়ল।

বিএনপির সমাবেশ মঞ্চের পেছন থেকে দৈনিক বাংলার দিকে এগিয়ে গেলাম। দৈনিক বাংলা মোড় পার হয়ে নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখা গেল। সেখান থেকে আবার ফিরে এলাম নয়াপল্টন হয়ে কাকরাইল নাইটিংগেল মোড়ে।

এবারের গন্তব্য বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট। আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ। বিজয়নগর পানির ট্যাংক পর্যন্ত বিএনপির সমাবেশের মাইকের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। রাস্তার পাশে অলস বসে আছেন পুলিশ সদস্যরা। কয়েকজনকে দেখলাম মোবাইল হাতে নিয়ে চোখ বুলাচ্ছেন। এগিয়ে একজনের সঙ্গে আলাপ করলাম। নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই পুলিশ সদস্য বললেন, ‘সকাল থেকেই এখানে দায়িত্ব পালন করছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও শান্তিপূর্ণ মনে হচ্ছে। এত কাছাকাছি বড় দুইটা দলের সমাবেশ, তারপরও বলার মতো কোনো ঘটনা এখনও ঘটেনি।’ বিজয়নগরের সড়কটি যে এত প্রশস্ত, আগে খেয়াল করিনি। নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ ও বায়তুল মোকাররমে আওয়ামী লীগের সমাবেশের মাঝের পথটুকুকে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ মনে হলো একবার! পল্টন মোড়ের একেবারে কাছে এসে দেখা গেল এক যুবক বড় একটি ব্যানার রাস্তায় রেখে ভাঁজ করছেন। সামনে এগিয়ে দেখা গেল ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রার্থী ফরহাদ হোসেনের ছবিসংবলিত ব্যানার। জানতে চাইলাম, ব্যানার গুটিয়ে রাখছেন কেন? এখনও তো সমাবেশ শেষ হয়নি? জানালেন, তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন এসেছিলেন, কিন্তু সবাই তাঁর কাছে ব্যানার রাখতে দিয়ে কোথায় যেন গেছেন। এখন একা একা ব্যানার ধরে রাখা কঠিন, তাই ভাঁজ করে রাখছেন। পল্টন মোড়ে দেখা গেল নিয়মিত ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা পুলিশের সঙ্গে অতিরিক্ত কয়েকজন। তারা মতিঝিল থেকে শাহবাগগামী রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন। রাস্তা পার হয়ে এক সময়ের মুক্তমঞ্চ, যেটি এখন ঘেরাও দিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে শ-খানেক লোকের জমায়েত। প্রায় সবার হাতে বিভিন্ন বক্তব্য লেখা ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড। সবটাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলমের ছবি। একজনের সঙ্গে কথা বললাম। নাম জানালেন– আবদুল হাই। বয়স ৭২। বললেন, ‘আওয়ামী লীগ ছাড়া জীবনে কাউকে ভোট দেই নাই। কিন্তু গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের সাথে আওয়ামী লীগ ঠিক কাজ করে নাই। আজকে এখানে আসার পর দেখা যাচ্ছে, জাহাঙ্গীর ছাড়া আর কারও তেমন লুক নাই।’

আবদুল হাইয়ের সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আরেক বয়স্ক লোক। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি পরিচয় দিয়ে জানালেন, তাঁর নাম মিয়ার উদ্দিন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, সমাবেশের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এক লাখ লোক জমায়েত করা হবে। আওয়ামী লীগের এই শান্তি সমাবেশে এক লাখ লোক আজকে হয়েছে কিনা? জবাবে তিনি হাসলেন। বললেন, তাঁর ওয়ার্ড থেকে অনেক নেতাকর্মী এসেছেন। কিন্তু এখন এখানে এসে মনে হচ্ছে, লোকজন কিছুটা কম। বৃষ্টি হয়েছিল, সেটাও কারণ হতে পারে।’

জিরো পয়েন্টে এসে দেখা গেল ইংরেজি ও বাংলায় বেশ কিছু প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। তাতে আমেরিকার পতাকা ও বাজপাখির ছবি দিয়ে লেখা: সাবধান বাজপাখি এসেছে। সাম্রাজ্যবাদী বাজপাখির থাবা রুখো। এমন সময়ে মঞ্চে আওয়ামী লীগের এক নেতার বক্তব্য শোনা গেল। সেখানেও যেন এ দৃশ্যের প্রতিধ্বনি। নেতা বলছিলেন: ‘বিএনপি এখন উপায় না পেয়ে বিদেশে গিয়ে বিচার বসাতে চায়। কিন্তু আবারও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন– ইনশাআল্লাহ!’ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের সমাবেশ মঞ্চটি বেশ গোছানো ও পরিচ্ছন্ন। ওপরে ডেকোরেটরের রঙিন শামিয়ানা টানানো।

ইম্পেরিয়াল হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে এক বোতল পানি হাতে নিয়ে গলা ভেজাতেই প্রথমে মনে পড়ল নয়াপল্টনের সেই রাজমিস্ত্রির কথা। আগামী নির্বাচন ঘিরে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল যেভাবে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার ঘোষণা দিল, সেটা শেষ পর্যন্ত কোন দিকে ধাবিত হবে? ‘সাংবাদিকরা সত্য বলে না’– এই যে অভিযোগ একজন মেহনতি মানুষ করেছেন, তা তিনি কেন বললেন? দেশের রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের কানে কি ওই রাজমিস্ত্রির বক্তব্য পৌঁছাবে?

দুটি জমজমাট জনসভা ঢাকার হারানো রাজনৈতিক ঐতিহ্য যেন ফিরিয়ে আনল। আবার দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি হুমকি থেকে ভয় হয়, রাজনৈতিক লড়াইয়ের মানিকজোড় হলো সংঘাত– সেটাও কি ফিরে আসছে আবার?

এহ্‌সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×