ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

রাজনীতি

নির্বাচন নিয়ে জাপার অবস্থান কি পরিষ্কার হলো?

নির্বাচন নিয়ে জাপার অবস্থান কি পরিষ্কার হলো?

মাহফুজুর রহমান মানিক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৩ | ০৬:২১

দেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শাসক আওয়ামী লীগ তো বটেই, তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির অবস্থান বেশ পরিষ্কারভাবেই আমরা জানি। আওয়ামী লীগ যেখানে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর, সেখানে বিএনপি বলছে– তারা কোনোভাবেই বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না। তবে ধোঁয়াশা ছিল জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাপা বা জাতীয় পার্টির এ ক্ষেত্রে অবস্থান নিয়ে। তারা বর্তমান সরকারের অধীনে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনে অংশ নিলেও, বিশেষত দলটির চেয়ারম্যান বরাবরই বলে আসছিলেন– এ সরকারের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব। তাঁর সরকারবিরোধী কথাবার্তা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এক পর্যায়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব জেগে যায়– অন্তত দশম সংসদ নির্বাচনে শাসক দলের উদ্ধারকর্তা বলে পরিচিত দলটি হয়তো এবার সে দায়িত্ব নেবে না। ওই নির্বাচন বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী দল অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলে বর্জন করেছিল।

 তবে সম্প্রতি সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে– দলটির চেয়ারম্যানসহ নেতৃবৃন্দ আগামী নির্বাচনে তাদের অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ইইউ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাপা চেয়ারম্যানের বিশেষ দূত মাশরুর মাওলা সমকালকে জানান, ইইউ প্রতিনিধি দল জানতে চেয়েছিল, আগামী নির্বাচনে জাপা কীভাবে অংশগ্রহণ করবে। তারা বলেছেন, জাপা ৩০০ আসনে এককভাবে প্রার্থী দেবে।

একদিকে জাতীয় পার্টি বিদেশিদের কাছে বলছে, তারা নির্বাচনে অংশ নেবে; অন্যদিকে দলের চেয়ারম্যান এ একারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে শঙ্কা জানাচ্ছেন। দলটির এই বিপরীতমুখী অবস্থান কেন? এমনকি সোমবার ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের দিনও তিনি বলেছেন, ‘এখন দেশে বিরাজনীতিকীকরণ চলছে। জনগণের কাছ থেকে রাজনীতি দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতি রাজপ্রাসাদে নেওয়া হয়েছে। কী হবে আর কী না হবে তা রাজপ্রাসাদেই সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে। সব সিলেকশন সেখানেই হচ্ছে। … মানুষ ভোট দিতে গেলে ভোট দিতে পারে না।’

মুখে যা-ই বলুক; জাপা যে সরকারের বিরাগভাজন হতে চায় না– সেটি তার কাজেই প্রমাণিত। অবশ্য সামরিক শাসনের গর্ভে জন্ম নেওয়া একটা দলের পক্ষে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভোটের হিসাবে ১৯৯১ সাল থেকে যে দলটি বরাবর তৃতীয় স্থানে রয়েছে; যে কারণে অনেকে তাকে ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যালান্সিং ফোর্স বলে অভিহিত করেন, সেই দলটি এ পরিস্থিতিতে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বৈঠক    -সংগৃহীত


সোমবারের ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের কথাই ধরা যাক। জাতীয় পার্টি এ আসনে এমন একজনকে দাঁড় করিয়েছে, যার কিনা ক্ষমতাসীনদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। তিনি মাত্র ১ হাজার ৩২৮ ভোট পেয়েছেন। অথচ দ্বিতীয় স্থানে থাকা হিরো আলম তাঁর চেয়ে কয়েক গুণ ভোট পেয়েছেন। আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের সে অর্থে কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই। ইউটিউবে সস্তা বিনোদন দেওয়াই যাঁর পেশা এবং নেশা। সেই হিরো আলম তাঁর পক্ষে জনসমর্থন টানতে পারলেন, অথচ জাতীয় পার্টি পারল না! ভোটের আগের দিন পর্যন্ত হিরো আলমকে নিয়ে অনেকেই মেতে ছিল। এমনকি ভোটের আগে একটি সংবাদমাধ্যম পরিচালিত জরিপে মানুষ তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভোট দেন; যেন তিনিই হচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য। প্রশ্ন হলো, হিরো আলম যদি অন্য এলাকা থেকে এসে ঢাকার নির্বাচনে এমন শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে পারেন, সেখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী কেন তাঁর চেয়ে পিছিয়ে? এই নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি ছিল না, সেই স্থান কি জাতীয় পার্টির হতে পারত না?

আসলে মানুষের মধ্যে এ ধারণা জন্মেছে– জাতীয় পার্টি ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে তাদের ভোট দেওয়া আর না দেওয়া প্রায় সমান। এর আগে আমরা দেখেছি, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ভোট পাওয়ার দিক থেকে ষষ্ঠ অবস্থানে ছিলেন। জাতীয় পার্টির অস্পষ্ট চরিত্রের কারণে দলটির ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ন হয়েছে, তেমনি মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা কমেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকট যেটা হয়েছে সেটা হলো, দলের মধ্যে বিভাজন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় পাঁচবার ভাঙনের মুখে পড়ে জাতীয় পার্টি। এখন তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং তাঁর ভাই জি এম কাদেরের মধ্যকার বিরোধ স্পষ্ট। এর মধ্যে রওশন এরশাদ ক্ষমতাসীনদের যতটা পক্ষে বলে জাহির করছেন; জি এম কাদের নিজেকে ততটাই বিরোধী ভাব দেখাচ্ছেন। তারা যদি একত্রিত হয়ে জনগণের পক্ষে কর্মসূচি দিয়ে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, নিঃসন্দেহে জাতীয় পার্টি আরও চাঙ্গা হতো এবং তাদের জনপ্রিয়তাও ফিরে পেতেন। সম্প্রতি সংসদে দ্রব্যমূল্যসহ একাধিক বিষয়ে জাপা বেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কথায় বলে– সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। জাপারও সেই দশা।

বর্তমানে দেশে কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা রাখার মতো রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বড় কথা, ধ্বংসাত্মক রাজনীতিবিরোধী একটা প্রবল জনমত দেশে তৈরি হয়ে আছে, জাপা যার সুযোগ নিতে পারত। কারণ জাপা নেতৃবৃন্দ প্রায়ই বলেন, তারা ‘গঠনমূলক’ বিরোধী দল হতে চান। কিন্তু দলটির চেয়ারম্যান বারবার সরকারের এমন সমালোচনা করেন যেন– তাদের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। আবার যখনই বিদেশিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তখন বলেন, তারা নির্বাচনে যাবেন। সেটা সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৈঠকে যেমন দেখা গেল, তেমনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকেও তারা ভোটের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। জাপা যদি সেই ২০১৪ সাল থেকেই ক্ষমতার মোহ ছেড়ে জনগণের ইস্যু নিয়ে কেবল সংসদেও সোচ্চার থাকত, তাহলেও দলটি হয়তো মানুষের এতটা আস্থা হারাত না।   

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, সমকাল [email protected]

আরও পড়ুন

×