ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

অজানা ভয়ের কাছে জিম্মি মন

অজানা ভয়ের কাছে জিম্মি মন

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

আজকের সময়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মতাদর্শগত ভিত্তি ও উদ্দেশ্য ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ধর্মীয় রাষ্ট্রের ধারণাটি মূলত দাঁড়িয়ে থাকে কতগুলো অন্ধবিশ্বাস আর যুক্তিহীনতাকে পাথেয় করে। সামাজিক-রাজনৈতিক স্তরে প্রগতিশীল ভাবনার সব সীমা অতিক্রম করে সামন্তবাদের অবশেষকে ধারণ করেই যার উদ্ভব এবং এগিয়ে চলার পথ।
একটি দেশে কতজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বাস– সে প্রশ্নটি প্রধান নয়। যদি একটি দেশে একজনও সংখ্যালঘু না থাকে, তারপরও দেশটি ধর্মনিরপেক্ষই হবে। কারণ বিংশ শতাব্দীতে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে আধুনিকতা; ধর্মনিরপেক্ষতা মানে প্রগতিশীলতা। এই প্রগতিশীলতার পথে হাঁটা মানুষদের মহান দেশচেতনার স্বরলিপিতে লুকিয়ে থাকা বহুত্ববাদের চিরায়ত গণতন্ত্রের বীজমন্ত্র একসঙ্গে উচ্চারণ করছে ঘৃণা আর সহনশীলতার দুটি পরস্পরবিরোধী শব্দ। সমাজচেতনার মাটি থেকে উৎসারিত চেতনা নিয়ে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার অপর নামই ধর্মনিরপেক্ষতা। 

ধর্ম, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক পরিচিতি প্রতিটি অক্ষেই শত্রু চিহ্নিত করে রেখেছে ধর্মান্ধ শক্তি। তাদের প্ররোচনায় আমাদের অনেকের ভেতরে যে অবিশ্বাস আর বিভেদের সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে, সেই সাপকে চিহ্নিত ও বিতাড়িত করতে বিলম্ব হচ্ছে। যত আমাদের বিলম্ব হচ্ছে তত পুষ্ট হচ্ছে সে। তাই তো দাঙ্গা হলে সেই দাঙ্গা থামানো গেলেও সাম্প্রদায়িকতাকে আটকানো যাচ্ছে না।

আমেরিকার প্রথম সারির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগার। এক পাশে রাখা হলো একটি মই। মইয়ের ওপরে বেঁধে রাখা হলো এক কাঁদি কলা। পরীক্ষাগারে ছেড়ে দেওয়া হলো দশটি বানর। কলার লোভে সব বানরই দৌড়ে গেল মইয়ের কাছে এবং মই বেয়ে উঠতে লাগল কলার কাছে। যখন তারা মইয়ের মাঝপথে, তখনই চারদিক থেকে হোজ পাইপের মাধ্যমে প্রবল গতিতে বরফ-ঠান্ডা পানি আছড়ে পড়ল বানরগুলোর শরীরে। প্রথমে তারা হতভম্ব। তারপর প্রাণপণে মই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। কিন্তু পানির তোড়ে শেষ রক্ষা হলো না। দশটি বানরই ছিটকে পড়ল এদিক-ওদিক। বানর মাটিতে পড়ে যেতেই বন্ধ করে দেওয়া হলো জলকামান। খানিকক্ষণ দেখে আবার মইয়ের দিকে রওনা দিল বানরের দল। কিন্তু মইয়ের মাঝপথে আবার একই বিপত্তি। নাছোড় বানররা কলা পেড়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেল আরও বেশ কয়েকবার। কিন্তু প্রতিবারই পড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা সইতে হলো তাদের। এক সময় হাল ছেড়ে দিল তারা। দেখা গেল, জলকামান বন্ধ করে দেওয়ার বহুক্ষণ পরও মইয়ের দিকে আর চট করে এগিয়ে গেল না কোনো বানর। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, দলের মধ্যে এক বানর সাহস করে মইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেও তাকে টেনেহিঁচড়ে থামিয়ে দিচ্ছে বাকিরা। ভয় বাসা বেঁধেছে বানরদের মনে। তাই তারা কলা থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তই শ্রেয় মনে করল।

গবেষকরা এর পর ওই দশ বানরের মধ্যে একটিকে চুপিসারে ঘরের বাইরে বের করে দিয়ে তার বদলে নতুন একটি বানরকে ঢুকিয়ে দিলেন। কলার কাঁদি ঝুলতে দেখেই নতুন বানরটি দৌড় দিল মইয়ের দিকে। কিন্তু সিঁড়ির কাছে পৌঁছানোর আগেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি ৯ পোড়খাওয়া বানর। এবার বিজ্ঞানীরা এক এক করে বাকি ৯ বানরকেই বদলে দিলেন। প্রতিবার নতুন বানর ঘরে ঢোকার পর পুরোনোদের একই প্রতিক্রিয়া। মইয়ের দিকে এগোলেই টেনে সরিয়ে আনা। একটা সময় এলো, যখন ঘরে দশ বানরই নতুন। প্রথমে যখন মইয়ে উঠতেই প্রতিবার পানি ছোড়া হচ্ছিল, তখন ঘরে ছিল না এদের কেউই। এরা এক এক করে পরে ঢুকে শুধু দেখেছে– মইয়ের দিকে উঠতে গেলেই রে রে করে তেড়ে এসে থামিয়ে দেয় পুরোনোরা। দেখা গেল, এর পরে ঘরে নতুন ঢোকা আরেক বানর মইয়ের দিকে এগোতেই একইভাবে রে রে করে তেড়ে গিয়ে থামিয়ে দিচ্ছে ওই আগে থেকে ঘরে থাকা ‘নতুন’ বানরগুলোও। সত্যিকারের জলকামানের ঠান্ডা স্রোতের সামনে এরা একবারও কিন্তু পড়েনি। তারপরও একই ঘটনা ঘটছে। এটিই অজানা ভয়। কস্মিনকালেও ঠান্ডা পানির অত্যাচার সহ্য না করা ওই বানরগুলোর পুরোনোদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, নিশ্চয় ওই মইয়ে চড়তে গেলে ভয়াবহ কোনো অনর্থ ঘটে। তাই ঠিক কী ঘটে, তা না জেনেও তারা এমন সন্ত্রস্ত।
অনেক কারণের মধ্যে ‘অজানা ভয়’ একটা বড় কারণ সাম্প্রদায়িক অস্তিত্বের মূলে। অজানা ভয়ের কাছে মনুষ্যত্ব আর কতকাল বন্দি থাকবে?

সুধীর সাহা: কলাম লেখক

আরও পড়ুন

×