ফিরে দেখা
একুশে আগস্টের হামলা, জঙ্গিবাদ এবং আসন্ন নির্বাচন

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৩ | ০৭:৫০
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের নৃশংস গ্রেনেড হামলার ১৯ বছর আজ। আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ঘটনাটির আলোচনা খুব প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সংঘটিত জঙ্গি হামলার মধ্যে সবচাইতে নৃশংস ছিল সেটি। সেদিন জনসভায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের সময় প্রকাশ্যে এ হামলা হয়। ওই হামলায় অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও দলটির তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও কয়েকশ আহত হন।
এটি কোনো আকস্মিক আক্রমণ ছিল না। আমরা জানি, ৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উদ্ভব হয়। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হামলা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির ওপর হামলা হয় ২০০১ সালে। আমরা দেখেছিলাম, বামপন্থি এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনের ওপর হামলা হচ্ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, এগুলো সরকারকে দুর্বল করা বা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য বিরোধী দলের চেষ্টার অংশ। এমনকি ২১ আগস্টের এই হামলার ক্ষেত্রেও বলা হয়, এটি আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে যখন সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা হয়, তখন এটি ঢেকে রাখার কোনো উপায় ছিল না। আন্তর্জাতিক চাপে সরকার তখন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। ততদিনে কিন্তু বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে গেড়ে বসে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বেরিয়ে আসে কীভাবে রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, এ হামলার পেছনে রাষ্ট্রের যোগসাজশ স্পষ্টও। জঙ্গি সংগঠন হুজি, লস্কর-ই-তৈয়বার মতো সংগঠনগুলো হামলার নেতৃত্বে ছিল। পাকিস্তান থেকে যে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল– সেগুলোর প্রমাণও আমরা পেয়েছি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-মামলার রায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এতে স্পষ্ট, সে সময় নিরাপত্তার ভার যাদের ওপর ছিল– স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন প্রধানরা তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

একই বছর অর্থাৎ ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে। সেই ঘটনায় প্রমাণিত হয়, গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে পাকিস্তান ও চীন থেকে এসব অস্ত্র এসেছিল। সেগুলো যাচ্ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার কাছে। এগুলো হচ্ছিল জনগণের অগোচরে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এমন কাজ করছিল, যা রাষ্ট্রের পুরোপুরি পরিপন্থি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলা আমরা দেখেছি। ওই ঘটনায় দেশি-বিদেশি অনেক মানুষ নিহত হয়। এ ঘটনায় আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে আরও শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করার ফলে এর পর বাংলাদেশে জঙ্গিরা তেমন
বড় হামলা করতে পারেনি। কিন্তু এর পরও দেখেছি, মুক্তচিন্তার অধিকারী ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের জন্য যারা লেখালেখি করতেন, তাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়। কয়েকজন ব্লগার নিহত হন। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপ এসেছিল। সরকার ঘটনাগুলো তদন্ত করে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও কার্যক্রম সম্পন্ন করেনি।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (পরবর্তী সময়ে আনসার আল ইসলাম) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিধনের তৎপরতা চালায়। সৌভাগ্যবশত সরকার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের অপতৎপরতা মোকাবিলা করে। সম্প্রতি সরকার ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’কে নিষিদ্ধ করে। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হুজির বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মী একত্রিত হয়ে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার কার্যক্রম শুরু করে। এর আগে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে আটটি সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হয় জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লার দল’।
এ ছাড়া ২০১৭ সালের ১ মার্চ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে ‘আনসার আল ইসলাম’কে নিষিদ্ধ করে সরকার। জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকায় এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহাদত-ই-আল হিকমা, ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি), ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহ্রীর এবং ২০১৫ সালের ২৫ মে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করা হয়। সপ্তাহখানেক আগে পুলিশ মৌলভীবাজারে অভিযান চালিয়ে ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামে একটি জঙ্গি দলের কয়েক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে। সমাজে উচ্ছৃঙ্খলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে পারে। সে জন্য সামনের দিনগুলোতে সমাজে যেন শান্তি বজায় থাকে এবং শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়, সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রচেষ্টা বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে উগ্রবাদ এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, যেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নেই। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার চেষ্টার মাধ্যমে যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়, তেমনি ২১ আগস্টসহ নানা জঙ্গিবাদী তৎপরতা আমরা দেখে আসছি। নির্বাচনের কারণে অতিসম্প্রতি জামায়াতসহ অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের তৎপরতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর ফেসবুকজুড়ে যে তৎপরতা দেখা গেছে, তাও উদ্বেগের।
গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স বা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। হলি আর্টিসানের পর গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮। আজকে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫। আফগানিস্তান, পাকিস্তানের অবস্থান একেবারে শুরুর দিকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, এমনকি জার্মানির মতো উন্নত বিশ্বের চেয়েও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত ভালো। কিন্তু এতেই আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।
২১ আগস্টের বোমা হামলার বার্ষিকীতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত রেখে প্রগতিশীলতার পথে আমাদের চলা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় দরকার। একই সঙ্গে দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে সবার এগিয়ে আসা উচিত। দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায় যেন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য ব্যাপক গণসচেতনতা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কর্মকাণ্ড সাধুবাদযোগ্য। তাদের মাধ্যমে অনেকেই সুপথে ফিরে আসছে। ধারাবাহিকভাবে সচেতনতা ও এসব তৎপরতা চালু রাখলে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ দূর হতে পারে। পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার জিরোসাম গেমের অবসান হতে হলে ইতিহাস থেকেও শিক্ষা নেওয়া দরকার।
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর; ট্রেজারার, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি