ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

গণপিটুনি কিংবা নরমাংস ভক্ষণ

গণপিটুনি কিংবা নরমাংস ভক্ষণ

মাহফুজুর রহমান মানিক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

সামষ্টিক কাজে এক ধরনের জোশ আসে। শ্রমিকরা বল পায় ‘হেঁইয়ো’ শব্দে। সমস্বরে যখন ‘হেঁইয়ো’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়, তখন প্রকাণ্ড গাছও বশ মানে। পানিতে থাকা গাছ ‘হেঁইয়ো’ টানে সুবোধ বালকের মতো ওপরে উঠে আসে। কথায় আছে– দশে মিলে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ। সামষ্টিক ভালো কাজে যেমন দেশ ও দশের উপকার হয়, তেমনি সামষ্টিকভাবে খারাপ কাজের ফলও ভয়াবহ হতে পারে। গণপিটুনি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কাউকে যখন আমরা গণপিটুনি দিচ্ছি, তখন তা নিছক পিটুনি থাকছে না। সেটা হয়ে যায় ক্যানিবালিজম বা নরমাংস ভক্ষণ।

 কাক নাকি কাকের মাংস খায় না। কিন্তু মানুষ নানাভাবে নরমাংস খায়। মানুষের মধ্যে যে সামাজিক ক্যানিবালিজমের প্রবণতা রয়েছে, তা আমরা দেখি হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও গণপিটুনির মধ্যে। হয়তো যাকে মারা হচ্ছে সে ‘অপরাধী’, কিন্তু তাকে শায়েস্তা করার জন্য আপনি কেন নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন? আবার অনেক সময় সত্য না জেনে সন্দেহের বশেই গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে। মারতে মারতে এমনকি তার প্রাণও আমরা নিয়ে ফেলছি। কতটা নির্দয় হলে এমনটা হতে পারে!

সাম্প্রতিক সময়ে গণপিটুনির যেন হিড়িক পড়েছে। চোর কিংবা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির অনেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। বলা বাহুল্য, সংবাদমাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তখনই এসব খবর আসে যখন প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। কোথাও মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাই মিলে হামলে পড়ছে একজনের ওপর। চোর আর ডাকাত হলে কিংবা খারাপ মানুষ জানামাত্রই গণপিটুনিতে সবাই শরিক হতে চায়! সবার আক্রোশের শিকার হলে তার আর বাঁচার পথ কোথায়? অথচ ব্যক্তি যদি সামান্য চুরিও করে, তবে কি তার অপরাধ প্রাণ হরণের যোগ্য? সম্প্রতি চট্টগ্রামে যে অঘটন আমরা দেখলাম, সেখানে কলেজছাত্র শিবলী সাদিককে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় উমংচিং মারমা নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যে পাহাড়ি এলাকা থেকে কলেজছাত্রের খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর পর পুলিশের কাছ থেকে উমংচিং মারমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়।

সন্দেহের বশেই উমংচিং মারমাকে গণপিটুনি দেওয়া হলো। তার বিচারের আগেই উত্তেজিত জনতা আইন নিজের হাতে নিয়ে নিল। পুলিশের হেফাজতে থাকার পরও তার শেষ রক্ষা হলো না। আমরা পুলিশকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। হয়তো ভাবছি, পুলিশের হাতে থাকলে বিচার হবে না। অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাবে। সে জন্য সোৎসাহে ‘ধর, মার এবং মাইরা ফালা’ শুনলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি কোনো চিন্তা ছাড়াই। যেন কান চিলে নিয়ে গেল বলে কান না দেখেই চিলের পেছনে ছোটা!

ক্যানিবালিজম প্রবৃত্তি আমাদের গ্রাস করছে। সহমর্মিতা, মানবতা, ন্যায়বোধ থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। মানবিক সমাজের যে পরিচয় আগে পাওয়া যেত, তা এখন দেখা যায় না। কেউ পানিতে পড়ে মারা যাচ্ছে, তখন হয়তো এক দল তার লাইভ করতে ব্যস্ত। বিপদে পড়া মানুষকে উদ্ধারের চিন্তা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। গণপিটুনি দেওয়ার আগে শিকার মানুষটির কথা কি আমরা ভাবতে পারি? চুরি, ডাকাতি কিংবা অপরাধের কারণে সে দুনিয়ায় থাকার অধিকার হারাবে? আমিই কেন তার হন্তারক হবো? মানুষের এ বোধ জাগ্রত করতে ন্যায়বিচার বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। 

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল [email protected]

আরও পড়ুন

×