ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম

পারমাণবিক বিশ্বে পদার্পণ সহজ কাজ নয়

পারমাণবিক বিশ্বে পদার্পণ সহজ কাজ নয়

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রোকন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ | ২০:৩৩ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৩ | ০৭:৩২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণায় ২৯ বছর ধরে নিয়োজিত। তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন কমিটি ছাড়াও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে শিক্ষকতা শুরুর আগে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। এই ফুলব্রাইট স্কলার যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগেরও অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। বুয়েট থেকে ১৯৯৫ সালে স্নাতক এবং জাপানের সাগা ইউনিভার্সিটি থেকে পরমাণু চুল্লির নিরাপত্তা বিষয়ে ১৯৯৭ সালে স্নাতকোত্তর ও ২০০২ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রিয়া, ইতালি, রাশিয়া, চীনে পরমাণু প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পরমাণু শক্তির জানা অজানা (২০১৫) এবং নিউক্লিয়ার পাওয়ার ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড বিয়ন্ড (২০২২)। শফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৭০ সালে কুমিল্লায়

সমকাল: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ‘স্বপ্নের বিদ্যুৎকেন্দ্র’ বলা হচ্ছে কেন?

শফিকুল ইসলাম: বলা হচ্ছে এই কারণে যে, এটা ছয় দশকের অপেক্ষার ফসল। পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর গ্রামে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৬১ সালে। তখন এ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণও করা হয়। কিন্তু ১৯৬৪ সালে রূপপুর প্রকল্পের জন্য যন্ত্রপাতিসহ বিদেশি জাহাজটি চট্টগ্রাম না এনে করাচি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের আগে পূর্ব পাকিস্তানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে না। ১৯৬৯ সালে একনেকে রূপপুরের জন্য ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি প্রকল্প অনুমোদন পেলেও আলোর মুখ দেখেনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক পটপরিবর্তনের পর পরবর্তী সরকারগুলো সেটি নিয়ে অগ্রসর হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া (প্রয়াত) প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় জ্বালানি নীতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সুপারিশও করা হয়। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বাধার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে আজ রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। 

সমকাল: পারমাণবকি বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দুর্ঘটনার শঙ্কা কতটা? বিশেষত বাংলাদেশের মতো ঘনবসতির দেশে?

শফিকুল ইসলাম: রূপপুর হচ্ছে তৃতীয় প্লাস প্রজন্মের পারমাণবিক চুল্লি। এ ধরনের আধুনিক ডিজাইনকৃত চুল্লিতে দুটি কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং-এর নিরাপত্তা বেষ্টনী সংযোজন ছাড়াও কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে উৎপন্ন বিস্ফোরক হাইড্রোজেনে নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতি রয়েছে। সংযোজন করা হয়েছে কোর ক্যাচার, যাতে চুল্লি গলে গেলেও তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে নির্গমন না হয়। এ ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী দ্বিতীয় প্রজন্মের চুল্লিতে নেই বিধায় চেরনোবিল ও ফুকুশিমায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। 

সমকাল: ইউরেনিয়াম পরিবহন বা সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও তো সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে–

শফিকুল ইসলাম: সরবরাহকৃত ইউরেনিয়াম জ্বালানি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। তারপর চুল্লিতে কীভাবে স্থাপন করা হবে, সে জন্যও রয়েছে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন। ইউরেনিয়াম জ্বালানি চুল্লিতে ঢোকানোর পরও বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় এবং প্রতিটি ধাপে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। 

সমকাল: ইতোমধ্যে ইউরেনিয়াম দেশে এসেছে। এর দাম সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

শফিকুল ইসলাম: পারমাণবিক জ্বালানির বাজার জীবাশ্ম জ্বালানির মতো নয় যে, ভূ-রাজনৈতিক কারণে দাম ওঠানামা করবে। পারমাণবিক জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে সাধারণত স্থিতিশীল থাকে। তবে ভবিষ্যতে কী হবে, বলা যাচ্ছে না। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিশ্বজুড়েই পারমাণবিক বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী দেশের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, পারমাণবিক জ্বালানির সরবরাহে চাপ বাড়তে পারে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, এর সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনাও বাড়তে পারে। 

সমকাল: পারমাণবিক জ্বালানি বিমানযোগে ঢাকায় এসে তারপর সড়কপথে পাবনায় গেছে। এভাবে পরিবহন কি নিরাপদ?

শফিকুল ইসলাম: বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহনে বিমান ও সড়কপথ অবলম্বন করা হয়েছে বলে মনে হয়। এভাবে নিরাপত্তাঝুঁকির নজির নেই। তবে টেকসই পরিবহনের কথা চিন্তা করলে আগামীতে পারমাণবিক জ্বালানি সমুদ্রপথে আসবে বলে আমার ধারণা। 

সমকাল: জ্বালানি সংগ্রহের ক্ষেত্রেও কি ভূ-রাজনীতি কাজ করতে পারে? সমকালেই প্রকাশিত এক নিবন্ধে আপনি পারমাণবিক জ্বালানির একাধিক উৎস ব্যবহারের কথা বলেছিলেন।

শফিকুল ইসলাম: একটি পারমাণবিক চুল্লির আয়ুষ্কাল হচ্ছে কমপক্ষে ৬০ বছর। সময় বর্ধিত করে ৮০ বছর পর্যন্ত চালানো যায়। রূপপুরে দুটি চুল্লি রয়েছে। ভবিষ্যতে রূপপুরে কিংবা অন্য কোথাও আরও চুল্লি নির্মাণের প্রয়োজন হতে পারে। তাই একক দেশের ওপর এত বছর ধরে জ্বালানিনির্ভর থাকা সমীচীন হবে না। কোনো দেশের বদলে বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা গেলে টেকসই ও সাশ্রয়ী মূল্যে পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্য দেশ থেকে নিজস্ব উদ্যোগে সংগ্রহের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গেও চুক্তি করেছে।

সমকাল: প্রথম চুল্লির জন্য জ্বালানি তো এসেছে। এখন কবে নাগাদ আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ পেতে পারি? 

শফিকুল ইসলাম: প্রথম চুল্লি থেকে দ্বিতীয় চুল্লিটি ৯ মাস পিছিয়ে। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রথম চুল্লিটি ২০২৪ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে; দ্বিতীয়টি যাবে তার পরের বছর। অনেকে মনে করেন, পারমাণবিক জ্বালানি আসার পরপরই বুঝি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে; গ্যাস, কয়লা বা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে হুট করেই চুল্লিতে জ্বালানি-রড স্থাপন বা ব্যয়িত রড তুলে ফেলা যায় না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু কিংবা বন্ধ করতে হয় অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে এবং আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কঠোর বিধিনিষেধ মেনে। 

সমকাল: দেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ ও ঘাটতি মোকাবিলায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে? 

শফিকুল ইসলাম: ২০২৫ সাল নাগাদ যদি দুটি পারমাণবিক চুল্লি চালু হয়, প্রায় ২১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। এ ধরনের স্থাপনাকে বলা হয় বেজলোড বিদ্যুৎকেন্দ্র। বড় কোনো ধরনের মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া এগুলো বন্ধ করা হয় না। দুই চুল্লি থেকে দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ১৫ শতাংশ নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ সম্ভব হবে। এতে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট কমবে বলে আমার ধারণা। 

সমকাল: পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী বলা হয়। কীভাবে– ব্যাখ্যা করবেন?

শফিকুল ইসলাম: ধরুন ১০৮০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ জীবাশ্ম জ্বালানিতে উৎপাদন করতে ১৮ মাস পরপর প্রায় ১ কোটি টন কয়লা বা ১৯ কোটি গ্যালন তেল লাগবে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এই পরিমাণ কয়লা ও তেল কিনতে যথাক্রমে ৭৩০০ ও ৬৩০০ কোটি টাকা লাগবে। ২৫ টন ইউরেনিয়াম জ্বালানি কিনতে লাগবে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ২০-২৫ বছর আয়ুষ্কাল এবং কার্বন নির্গমনের বিষয়টি তো রয়েছেই। পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব।

সমকাল: পরিবেশবান্ধব কীভাবে?

শফিকুল ইসলাম: পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম জ্বালানিতে ফিশন বিক্রিয়ার কারণে এতে কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয় না। অপরদিকে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন অবধারিত।

সমকাল: বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ৩২ বা ৩৩তম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। আমাদের মতো অর্থনীতির আর কোনো দেশ কি এই তালিকায় রয়েছে?

শফিকুল ইসলাম: খুব বেশি নেই। আমাদের কাছাকাছি অর্থনীতির দেশের মধ্যে মিসর বা তুরস্কের কথা বলা যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অনেক দেশই বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় ও পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে আগামী প্রজন্মের অধিকতর নিরাপত্তা ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তিসংবলিত ছোট ছোট মডিউলার টাইপ চুল্লি নির্মাণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সমকাল: পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় কারিগরি ক্ষেত্রে আমরা স্বয়ংসর্ম্পূণ হতে পারব, নাকি বিদেশনির্ভরই থেকে যাব?

শফিকুল ইসলাম: এটা নির্ভর করছে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা ও তদনুযায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জনে সময়োচিত পদক্ষেপের ওপর। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় আমাদের এখন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশের ওপর। বিদেশনির্ভরতা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি।

সমকাল: একটু স্পর্শকাতর একটি প্রশ্ন করি। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্পের মধ্যে পার্থক্য কী কী?

শফিকুল ইসলাম: পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প হচ্ছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মানবকল্যাণের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প কিংবা কেন্দ্র থেকে কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা যায় না। বাংলাদেশ মানবকল্যাণের জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বদ্ধপরিকর। যার জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ এবং আইএইএ প্রযোজিত পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের সব চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। 

সমকাল: পারমাণবিক জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করবে বাংলাদেশ?

শফিকুল ইসলাম: দেখুন, বাংলাদেশে এবারই প্রথম ইউরেনিয়াম আসেনি। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে পরমাণু শক্তি কমিশনের সাভারে অবস্থিত গবেষণা চুল্লি চালু করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর সমৃদ্ধকরণ ইউরেনিয়াম জ্বালানি আনা হয়েছিল। এখন কেবল বাণিজ্যিক চুল্লি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক জ্বালানির মালিক হলাম মাত্র। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে পারমাণবিক জ্বালানির হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে। আইএইএ এই হিসাব কাগজ-কলমে ও সরেজমিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। এ ক্ষেত্রে এক চুলও ব্যত্যয় গ্রহণযোগ্য হবে না। এই পদ্ধতিই যে কোনো দেশের জন্য পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মূল ভিত্তি।

সমকাল: পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আইএইএ এবং বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক কীভাবে নির্ধারিত হবে?

শফিকুল ইসলাম: বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আইএইএর সদস্য হয়েছে। সদস্যপদ লাভের পর থেকেই আইএইএ বাংলাদেশকে কারিগরি ও জনবল প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় নিয়েছে। পরমাণু গবেষণা চুল্লি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, পরমাণু চিকিৎসা, কৃষি ও অন্যান্য মৌলিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের শুরু থেকেই চুল্লির নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দিয়ে আসছে আইএইএ। এখন আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।

সমকাল: পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা শঙ্কার কথা শোনা যায়।

শফিকুল ইসলাম: রাশিয়া এ ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। ইউক্রেন যুদ্ধ চলা সত্ত্বেও জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তবে সরবরাহকারীর কাছ থেকে কারিগরি মানসম্পন্ন পারমাণবিক জ্বালানি সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া, সব হিসাব সংরক্ষণ করা, জ্বালানি সংরক্ষণাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মাধ্যমিক ও নিম্নস্তরের বর্জ্য ব্যবস্থাদির ভৌত অবকাঠামো, বিকিরণ পর্যবেক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

সমকাল: রূপপুরের পর বাংলাদেশে আরও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুতের সম্প্রসারণ কতটা দূরদর্শী?

শফিকুল ইসলাম: বর্তমানে সবচেয়ে ঝুঁকি হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও পারমাণবিক বিদ্যুৎই আগামীর ভরসা। সার্বিক বিবেচনায় পারমাণবিক বিদ্যুতের দিকে যাওয়া ও সম্প্রসারণ করা যুক্তিযুক্ত ও দূরদর্শী বলে আমি মনে করি। 

সমকাল: শেষ প্রশ্নটি করি। বাংলাদেশে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত কী?

শফিকুল ইসলাম: পারমাণবিক বিশ্বে নবাগত দেশের পদার্পণ সহজ কাজ নয়। এর ভূ-রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষিত অবশ্যই রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হলে রাষ্ট্রকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ; সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সম্মতি ও সহযোগিতার মাধ্যমেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।

সমকাল: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

শফিকুল ইসলাম: সমকালকেও ধন্যবাদ। 

আরও পড়ুন

×