ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

দৃষ্টিভঙ্গি

কবি রাধাপদের হেনস্তার আসল কারণটা কী

কবি রাধাপদের হেনস্তার আসল কারণটা কী

নাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০

‘সরকারি চাকরি করে বেতন ৫ হাজার/ ৫০ হাজার টাকা মাসে খরচ দেখি তার/ বাকি টাকা কেমনে আসে সেকথা আর বলি না/ কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানি না।’ কথাগুলো কবি রাধাপদ রায়ের। তিনি মুখে মুখে গান ও ছড়া লিখে জনপ্রিয়। তাঁর ওপর সম্প্রতি হামলা করে গ্রামেরই আরেকজন। সেই ঘটনায় সারাদেশে নিন্দা ওঠা স্বাভাবিক এবং তা হয়েছেও।

ছয় মাস আগে সালিশে কথা কাটাকাটির জেরে কবি রাধাপদ রায়ের ওপর এ হামলা। রাধাপদ রায়ের ছেলে জুগল রায় বলেন, তাঁর বড় ভাই মাধব রায় ও নাগেশ্বরী পৌরসভার হাসেমবাজার এলাকার মিলন ঢাকায় একসঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। পরে মিলন এলাকায় এসে দাবি করেন, তিনি মাধব রায়ের কাছে কাজের টাকা পাবেন। এ নিয়ে তিনি ছয় মাস আগে এলাকায় সালিশ ডাকেন। সেখানে একসঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করা স্থানীয় শ্রমিকরা উপস্থিত হন। ওই অনানুষ্ঠানিক সালিশে হিসাবের খাতায় দেখা যায়, মিলন ৫০০ টাকা পাবেন। পরে সালিশ বৈঠকের মাধ্যমেই তা ফেরত দেন রাধাপদ রায়।

জুগল রায় বলেন, ওই সালিশে একই উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের কচুয়ারপাড় এলাকার কদুর রহমান এসে উপস্থিত হন। তিনি এলাকায় গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামোর নির্মাণকাজ চলাকালে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলেন রাধাপদ রায়ের স্ত্রীর বিরুদ্ধে। সে সময় কদুর রহমানের সঙ্গে রাধাপদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়, যা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। পরে কদুর রহমানের ছোট ভাই মো. রফিকুল ইসলাম এ ঘটনার প্রতিশোধ নেবেন বলে হুমকি দেন।

ওই সালিশে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা লিটন রায় (২৯)। তিনিও রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি বলেন, টাকা পাওয়ার অভিযোগ নিয়ে রাজমিস্ত্রিদের ফোরম্যানসহ ১০-১২ জন বসেছিলেন। সেখানে কদুর রহমান টাকা মেরে খাওয়া নিয়ে ভর্ৎসনা করতে থাকেন। কবির স্ত্রীকে নোংরা ভাষায় গালি দেন। এতে কবি ক্ষিপ্ত হলে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

গত ১১ অক্টোবর বাংলা ট্রিবিউন জানায়, মামলার সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, রফিকুল কবি রাধাপদকে ধাক্কা দিলে উভয়ের ধস্তাধস্তিতে রাস্তার পাশে থাকা শামুকের স্তূপে পড়ে আঘাত পান কবি। সে সময় সেখানে স্থানীয় কয়েকজন যুবক উপস্থিত ছিলেন। তবে সেখানে রফিকুলের বড় ভাই কদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন না।

টাকা ধার দেওয়া-নেওয়া যেখানে চলে, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আপনারা খুঁজতে পারেন, কিন্তু তা সত্য নয়। টাকা লেনদেনের একপর্যায়ে নানান কথায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা থাকে। ঝগড়ায় উজানের লোক ভাটির প্রতিপক্ষকে ভাটিয়া বলে, কাইমের বাসিন্দারা চরুয়া বলে, পাহাড়ি হলে সেটেলার বলে, স্থানীয় হলে উঠানি বা নওদা বলে। তেমনি মুসলমান হলে হিন্দু বলে। ইদানীং দুর্বল প্রমাণ করতে রোহিঙ্গা বলে। নাগেশ্বরীর ঘটনার পর মুরুব্বিরা চ্যাংড়া-বেংড়াকে (ছেলেপেলে) শাসন করতে হয়তো দ্বিধা করবেন। কিন্তু এটা সাম্প্রদায়িক ঘটনা না। এলাকার ভাই বেরাদরের ঝগড়া। এগুলো আসলে গ্রামের মুরুব্বিদের দিয়ে বিচার করার মতো ঘটনা। সবকিছুতে কোর্ট-কাচারি বা রাষ্ট্র চলে এলে সমাজের শক্তি ক্ষয় হয়। যে ঘটনায় সমাজের বিচারের মাধ্যমে সমাধান করা যায়, সেটা রাষ্ট্রের দ্বারা সমাধান চাইলে ক্ষত বাড়া ছাড়া কমে না। তার বড় প্রমাণ গ্রেপ্তারকৃত রফিকুলের বড় ভাই কদু ঘটনাস্থলে উপস্থিতই ছিলেন না, কিন্তু এখন তিনিও আসামি। ঘটনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা ট্রিবিউনে। তাদের কাছে কবি রাধাপদ কদুর ইন্ধনের কথা অনুমানে বলেন। প্রতিবেদক প্রকৃত তথ্য যাচাই করেননি, পুলিশও করেনি। অথচ এজাহারে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে।

সাম্প্রদায়িকতা (ইংরেজি: Communalism) হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয়, যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। এখানে রাধাপদ কাকাকে কি হিন্দু হওয়ার জন্যই আঘাত করা হয়েছে? সব পত্রিকা বলছে, তা নয়। তাহলে?

আমরা তো রাধাপদ কাকা ও কদু ভাই একই গাঁয়ের লোক। একজন আরেকজনের বালতি থেকে কাঁকড়া তুলে নেওয়ার সম্পর্ক। আমরা শিক্ষিতরা সেখানে সাম্প্রদায়িকতা দেখতে না পেয়ে উল্টা তা ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এর ফলাফল কী? রাধাপদ কাকা একঘরে হয়ে যাবেন। ধীরে ধীরে মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে মিশবেন না। ভয়ে মিশবেন না। ঘরের ঝগড়ায় বাইরের লোককে ডেকে আনলে সমাজে অপমানবোধ জেগে ওঠে। অপমান থেকে অভিমান, হিংসা। এভাবে নিজের অজান্তেই উল্টো সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দিই। প্রগতিশীল বন্ধুদের এই হুঁশে আসতে হবে, উপকার করতে গিয়ে অপকার না করে ফেলি! নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক [email protected]

আরও পড়ুন

×