রাজনীতি
সংলাপ হোক নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নিয়ে

আবু সাঈদ খান
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩ | ০৭:৪৭
নির্বাচন ঘিরেই সংকট। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, জনমনে ততই উদ্বেগ বাড়ছে। সবার প্রশ্ন, কী ঘটতে যাচ্ছে? উত্তর কারও জানা নেই।
১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের আগে আন্দোলনরত তিন জোট দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল এবং আন্দোলনের মাধ্যমে তা আদায় করেছিল। তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক বিধান প্রবর্তনে বাধ্য হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা প্রণয়নকালে জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ পাঁচ দল ও আট দলের অন্তর্ভুক্ত সিপিবিসহ কতিপয় বাম দল ন্যূনতম তিন মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান প্রবর্তনে সোচ্চার ছিল। বিষয়টি রূপরেখার খসড়ায়ও ছিল, যা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একযোগে প্রত্যাখ্যান করে। মনে পড়ে, তখন তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটির ওই বৈঠকে পাঁচ দলের হয়ে আমি উপস্থিত ছিলাম এবং কমপক্ষে তিন মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করার পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলাম। আমার বক্তব্যের মাঝখানে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ রসিকতার সুরে বললেন, তোমরা ক্ষমতায় এসে এ বিধান কোরো। বিএনপি নেতা মেজর জেনারেল (অব.) মাজেদুল হক তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন, সবকিছু এবার করে ফেললে বামপন্থিদের কোনো কাজ থাকবে না…। সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক বিধান প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে পরবর্তী সময়ে নতুন করে আন্দোলনের প্রয়োজন হতো না।
সে সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তিন মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রত্যাখ্যান করার কারণ বোধগম্য। উভয় দলই ক্ষমতায় আসবে বলে স্বপ্ন দেখছিল। আর হয়তো ভাবছিল, ক্ষমতায় থেকেই পরবর্তী নির্বাচন করবে এবং বিজয় ছিনিয়ে নেবে। দুই দলেরই অভিজ্ঞতা ছিল– দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হয় না। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে। বিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপি দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছে। বাম ও ইসলামী দলগুলোর দাবি একই। ক্ষমতা ধরে রাখতেই ১৯৯৬ সালে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে চাইছিল না। একই কারণে আওয়ামী লীগও এখন তা মানতে চাইছে না। সেই রাস্তা বন্ধ করতেই ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করেছে। যদিও আদালতের রায়ে দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার সুযোগ ছিল।
১৯৯৬ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য বিএনপির গোঁ ধরা এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা কোনো নীতিগত বিষয় নয়; সুবিধাবাদী অবস্থান মাত্র।
এখন দলীয় সরকার বনাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক তুঙ্গে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি বক্তব্য বিস্ময়কর। তারা বলছেন, আমরা ’৯৬ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনে বিএনপিকে বাধ্য করেছিলাম। কিন্তু বিএনপি সেই দল না, আওয়ামী লীগকে বাধ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। বিএনপির সেই ক্ষমতা আছে কিনা, সে আলোচনায় যাব না। প্রশ্ন হচ্ছে, আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই বলে কি সঠিক প্রস্তাব বেঠিক হয়ে যাবে? আর আন্দোলনের ক্ষমতা থাকলে কি বেঠিক প্রস্তাব সঠিক হয়ে যাবে? আসলে কোনটি সঠিক, আর কোনটি বেঠিক তা যুক্তির নিরিখেই বিচার করতে হবে। খতিয়ে দেখতে হবে যে ’৯৬-তে যা সঠিক ছিল, তা কেন এবং কোন যুক্তিতে আজ বেঠিক হবে? বরং ২০১৪ ও ’১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর সচেতন মহল বুঝতে পারছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই।
ক্ষমতাসীনরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে– দলীয় সরকারের অধীনেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, যা কেউ বিশ্বাস করছে না। নির্বাচন কমিশনও সেই বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। বরং তাদেরকে সরকারের আজ্ঞাবহ বলেই মনে হচ্ছে। এটি ঠিক যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করেছে। এখানে লক্ষণীয়, সরকার চাইলে ভালো নির্বাচন হয়, আর না চাইলে তা হয় না। সরকারের চাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ; নির্বাচন কমিশনের পারদর্শিতা নয়। তার চেয়ে বড় কথা, স্থানীয় সরকার বা উপনির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না বলে কখনও কখনও সরকার নিরপেক্ষ থাকে। তবে জাতীয় নির্বাচনে সরকারের কাছে সেই নিরপেক্ষতা আশা করা যায় না। তাই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রশ্নে নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনার কথাই ভাবতে হবে। তবে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই একমাত্র সমাধান বলে মনে করি না। এ ক্ষেত্রে সর্বদলীয় সরকার বা জাতীয় সরকারের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে কতিপয় মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিতে বলেছিলেন। ওই প্রস্তাবে বিএনপি রাজি হলে এবং অন্যান্য বিরোধী দল যোগ দিলে তা হতো সর্বদলীয় সরকার বা জাতীয় সরকার। এ ব্যাপারে এখন সমস্যা দাঁড়িয়েছে যে, বিএনপি সংসদে নেই। এর সমাধানও আছে। বিএনপি থেকে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর মর্যাদায় উপদেষ্টা নিয়োগে সংবিধানে কোনো বাধা নেই। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সংবিধান কোনো বাধা নয়। ১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সংবিধানের আলোকেই গঠিত হয়েছিল। আন্দোলনরত তিন জোটের সমঝোতাই ছিল এর মূল ভিত্তি। সমাধানের একাধিক পথ খোলা। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যার পরিচয় সরকার ও বিরোধী দলকে দিতে হবে; উভয়কে এক টেবিলে বসতে হবে। সংগত কারণেই সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে; উদারতার পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশে অর্থনৈতিক সংকট বিরাজ করছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিরাট অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
মনে রাখা দরকার, অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট এক রেখায় মিলিত হলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান আশঙ্কা করছেন, যা কারও কাম্য হতে পারে না। দেশের সবার স্বার্থে দুই প্রধান দলকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে; উভয় দলকে ছাড় দিতে হবে। তবে ২০১৪ বা ’১৮-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে– এমন কোনো প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। আলোচনার এজেন্ডা হতে পারে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন; যা নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থাপনা ভিন্ন আদৌ কি সম্ভব? আবু সাঈদ খান: বীর মুক্তিযোদ্ধা;
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
- বিষয় :
- আবু সাঈদ খান
- রাজনীতি
- নিরপেক্ষ নির্বাচন