ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বন্য হাতির প্রাণহানি

এই আত্মঘাত বন্ধ হোক

এই আত্মঘাত বন্ধ হোক

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০

শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার মালাকোচা গ্রামে মঙ্গলবার ভোরে যেভাবে একটি হাতির মৃত্যু হয়েছে, তা মর্মান্তিক। বিদ্যুতায়িত তার দিয়ে ঘিরে রাখা সবজি ক্ষেতে প্রবেশের সময় হাতিটি প্রাণ হারায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা জানি, ওই অঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে 'হাতি তাড়ানোর' এই নৃশংস পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। বন্য হাতির জন্য যে কোনো ধরনের ফাঁদ পাতা বেআইনি তো বটেই, এর মধ্য দিয়ে সংশ্নিষ্টদের অমানবিকতাও প্রকাশ পায়। অবলা প্রাণীর প্রতি এ ধরনের আচরণ আমাদের যেমন উদ্বিগ্ন করে, তেমনই ক্ষুব্ধ করেছে। স্বীকার করতে হবে, ভারতের গারো পাহাড় সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অঞ্চলে বন্য হাতির 'তাণ্ডব' নতুন নয়। প্রায়ই দলে দলে হাতি সীমান্ত পার হয়ে এসে ফসল ও বাড়িঘরের সমূহ ক্ষতি করে। এসব 'হানা' সাধারণত কয়েক দিন স্থায়ী হয়। কিন্তু এই মৌসুমে তা যেন প্রলম্বিত হয়েছে।

সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা দেখছিলাম যে স্থানীয়রা রাত জেগে, আগুন জ্বালিয়ে ও বিভিন্নভাবে হল্লা করে হাতি তাড়াচ্ছে। 'লোকায়ত' এসব পদ্ধতির মধ্যে 'আধুনিক' বিদ্যুতায়ন ব্যবস্থা অপূরণীয় ক্ষতি করে দিল। এভাবে হাতির প্রাণহানি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটাও ঠিক, যেসব কৃষকের সারাবছরের খাদ্য চোখের সামনে হাতির ভোগে লাগে, তখন তাদের পক্ষে স্থির থাকা কঠিন। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের আগেই উচিত ছিল সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও নজরদারি প্রয়োজন।

সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, যে সবজি ক্ষেতে বিদ্যুতায়িত হয়ে হাতিটি মারা গেছে, সেটি ছিল বন বিভাগের বেদখলকৃত জায়গা। বনের জায়গা দখল করে বন্য হাতি মেরে ফেলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির খুঁটির জোর কোথায়, খতিয়ে দেখা জরুরি। আমরা মনে করি, হাতি ও মানুষের প্রাণ ও সম্পদ কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়- এ ব্যাপারেও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভাবার সময় হয়েছে। এই প্রশ্ন অবশ্য সব সময়ই সংগত- হাতি কখন নিজের আবাস ছেড়ে অন্যের ঘরে উৎপাত করে? বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলে আসছেন, বন্যজন্তুর চিরায়ত আবাস যখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে, তখনই তারা কেবল লোকালয়ের দিকে ছোটে।

আমরা জানি, অব্যাহত বৃক্ষ নিধনের ফলে সীমান্তের দুই পাশেই হাতিসহ বিভিন্ন জীবজন্তু আবাসস্থল কীভাবে হারাচ্ছে। ফলে খাদ্য সংকটে পড়া হাতির দল লোকালয়ে চলে আসছে। সমকালের আলোচ্য প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, শেরপুর বন বিভাগের আওতাধীন বনাঞ্চলে একসময় হাতি ছাড়াও বাঘ, হরিণ ও ভালুক বিচরণ করত। সেই বনাঞ্চল থেকে স্থানীয় প্রজাতির গাছপালা ও ফলদ বৃক্ষ প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার ফলে ক্রমে এসব প্রাণীর অধিকাংশ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। বস্তুত সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক প্রতিবেশ ব্যবস্থাই বিনষ্ট হয়েছে। এখনও ওই অঞ্চলে যেসব বন্য হাতি কোনোরকমে বেঁচে রয়েছে, সেগুলোও ভুগছে চরম খাদ্য সংকটে। কেবল গারো পাহাড় অঞ্চলে নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলেও প্রায়ই বন্য হাতি মারা যাচ্ছে।
গত শনিবারও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ধানের ক্ষেত থেকে এই হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। শেরপুরের মতো সেই হাতিও মারা গিয়েছিল বিদ্যুতায়িত হয়ে। এর অর্থ সর্বনাশা এই 'পদ্ধতি' সারাদেশেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে এখনই শূন্য সহিষ্ণুতা ছাড়া হাতির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়ানো যাবে না। আমরা মনে করি, হাতির আবাসস্থল রক্ষাই হচ্ছে মানুষের সঙ্গে এর সংঘাত এড়ানোর সর্বোত্তম উপায়। সে ক্ষেত্রে প্রথমে জোর দিতে হবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষার প্রতি। একই সঙ্গে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে বন্য হাতি নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণে। কারণ, হাতির চলাচলের পথ মোটামুটি নির্দিষ্ট। ওই অঞ্চলে জনবসতি ও ফসলের ক্ষেত নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মানুষ ও হাতির সংঘাতও নিয়ন্ত্রণে আসবে। তার বদলে উপকারী বন্ধু হাতি এভাবে প্রাণ হারাতে থাকলে তা পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্যও হয়ে উঠবে প্রাণঘাতী।

আরও পড়ুন

×