ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পরিবেশ বিপর্যয়ে দায়ী ই-বর্জ্য

পরিবেশ বিপর্যয়ে দায়ী ই-বর্জ্য

মোশারফ হোসেন

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৪:২৯

বর্তমান সময়ে ই-বর্জ্যকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান বর্জ্য প্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়; সারাবিশ্বের সমস্যা। যদিও উন্নত বিশ্ব এ ব্যাপারে সচেতন, কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত অন্ধকারেই পড়ে আছি। ই-বর্জ্য হচ্ছে ইলেকট্রনিক বর্জ্য। যেমন পরিত্যক্ত কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টিভি, ফ্রিজ, ক্যামেরা, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওভেন, মুঠোফোন, সিএফএল বাল্ক্ব, ডিভিডি প্লেয়ার, ইলেকট্রনিক খেলনা সামগ্রী ইত্যাদি। আধুনিক জীবন এখন পুরোটাই যন্ত্রনির্ভর। বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র প্রতিনিয়ত তৈরি করছে বিপুল ই-বর্জ্য। এর উৎসটা কয়েক দশক আগেও অনেকটা সীমিত পরিসরে ছিল। বাজার সংস্কৃতির এই যুগে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ ঘটার সুবাদে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনের ভোক্তা চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বৃদ্ধির প্রায় ১০ শতাংশ হারের ৫ শতাংশের বেশি পুনরুদ্ধার করা যায় না। ই-বর্জ্যে মানবদেহ তথা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ব্যবহূত ইলেকট্রনিক সামগ্রীতে নানা ধরনের উপাদান থাকে। যেমন- ক্যাডমিয়াম, সিসা, সিলিকন, লেড-অক্সাইড, লিথিয়াম, কার্বন, আর্সেনিক, বেরিলিয়াম, ফাইবার গ্লাস, পারদসহ নানা ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান। ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেলেও ওই ক্ষতিকারক উপাদানগুলো নিঃশেষ হয়ে যায় না। ওই বর্জ্যের মধ্যেই থেকে যায়। এগুলো পচনশীল না হওয়ার কারণে পরিবেশের অন্যতম উপাদান মাটি-পানি-বায়ু, ফুল-ফসল ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবমতে, দেশে প্রায় ১৩ কোটি মোবাইল ফোন চালু আছে। গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রতিটি মোবাইল ফোনে গড়ে যে পরিমাণ লেড নামক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকে, তা দিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার গ্যালন পানি দূষিত করা সম্ভব। এ ছাড়াও মোবাইল ফোনের ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, আর্সেনিক ও ক্লোরিনের মতো ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে পানি ও মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে বিষ মানবদেহে ঢুকে পড়ছে। গবেষণা থেকে জানা যায়, এক চা চামচ পরিমাণ পারদ প্রায় ২০ একরের একটি জলাশয়ের প্রাণীর আজীবন ব্যবহারের অনুপযোগী।

ইলেকট্রনিক বর্জ্য যেসব রাসায়নিক উপাদান ধারণ করে, তার বেশিরভাগই মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। লেড সাধারণত কিডনি, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া এবং শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ক্যাডমিয়াম মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিষাক্ত, যা কিনা কিডনি, লিভার এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। পারদ মস্তিস্কের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে। শ্বাসকষ্ট ও ত্বকের ব্যাধি সৃষ্টি করে। লিথিয়াম বুকের দুধে প্রবেশ করতে পারে। ইনহেলশন ফুসফুসের ক্ষতি করে। পেটের ব্যথা,বমি বমি ভাব, যকৃতের ক্ষতি বা উইলসন রোগের কারণের জন্য দায়ী।

রিসাইক্লিং কারখানা স্থাপন করে আবার ব্যবহার উপযোগী যন্ত্রাংশ তৈরি করে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানা তৈরি করে সম্ভাবনাময় শিল্প গড়ে উঠতে পারে। তাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে প্রায় চার লাখ বর্জ্য শ্রমিক কাজ করে। তার মধ্যে শুধু ঢাকা শহরে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক রয়েছে। ই-বর্জ্য পরিশোধন করে কপার বা স্বর্ণের মতো মূল্যবান ধাতু সংরক্ষণ করা যেতে পারে। প্লাস্টিক থেকে উৎপন্ন জ্বালানি তেল, ছাপাখানার কালি, গ্যাস উৎপাদন করার ফলে একদিকে দূষণরোধ হচ্ছে, অন্যদিকে সম্পদ তৈরি হচ্ছে। তার সঙ্গে শিল্পপণ্যের বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ভারত প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে তৈরি করছে ডিজেল, কেরোসিন। সারাবিশ্বে সর্বপ্রথম বর্জ্যমুক্ত দেশ হচ্ছে জাপান। আমাদেরও সেই পথে হাঁটতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। তাই বিপর্যয় ঠেকাতে এখনই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

মোশারফ হোসেন : প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ
[email protected]

আরও পড়ুন

×