ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গণ্ডি পেরোনো দুই বন্ধু

গণ্ডি পেরোনো দুই বন্ধু

সুবর্ণা মুস্তাফা ও সব্যসাচী চক্রবর্তী

মীর সামী

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ০৪:৩০ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ০৪:৩৭

সমাজের ক্যানভাসে আজও অনেক মানুষ একা। আমাদের সমাজে মধ্যবয়সী অনেক মানুষ একাই নিজের মতো করে জীবন কাটান। কিন্তু নিজের বিষয়ে একা কি তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? পারেন না। কারণ, ধর্মীয় অনুশাসন আর সামাজিক প্রথা অনেক সময় এ বয়সী মানুষের মনের স্বাধীনতাকেও আটকে রাখে। শুধু তাই নয়, খোলা আকাশের নিচে নিজের পছন্দমতো বন্ধু বা বিশেষ বন্ধুকে নিয়ে ঘোরার বা সময় কাটানোর অধিকার তার নেই। এমনই দু'জন বয়স্ক মানুষের গল্প নিয়ে 'ভুবন মাঝি'খ্যাত পরিচালক ফাখরুল আরেফীন খান নির্মাণ করেছেন তার নতুন চলচ্চিত্র 'গণ্ডি'। শুভজিৎ রায়ের 'পথের সাথী' অবলম্বনে নির্মিত এ ছবির গল্প দুই অচেনা বয়স্ক মানুষকে ঘিরে। তারা বাড়িতে একা থাকেন। তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। কোনো এক দিন এই দু'জন অপরিচিত মানুষের পরিচয় হয়। আলাপ হয়। জমে কিছু প্রেমাস্পর্শ। নিজের সিদ্ধান্তে তারা বাঁচতে চান। তাদের সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের মানুষ। কী সেই সিদ্ধান্ত? কেন বিরোধিতা করে তাদের সন্তানরা। তারপর? তারপর আর নাই-বা বললাম, বাকিটা না হয় পর্দায়ই দেখে নেবেন কী ছিল। আমাদের সমাজের খুব চেনা ছবি থেকে অচেনা এক গল্প রুপালি পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন ফাখরুল আরেফীন। 'গণ্ডি' ছবিতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, বন্ধুত্বের গল্প। যে বন্ধুতা কোনো সমাজ, ধর্ম বা কাঁটাতার মানে না। ছবিতে মানুষের অন্তর সমস্যার মানসিক দৃশ্যপট তুলে ধরে বলতে চেয়েছেন বন্ধুত্বের মতো মানবিক জায়গা আর কিছু নেই।

সিনেমা 'গণ্ডি' যত না বয়সের, তার চেয়ে বেশি মানসিকতার। বেশি বয়সের একাকিত্ব, নির্দিষ্ট উঠান, ঘরবাড়ি, দরজা-জানালা এবং মানুষ। কেন? এর বাইরে নয় কেন? কেন বেশি বয়সে নয় নতুন বন্ধুত্ব? কেন নয় নতুন গল্প, নতুন উচ্ছ্বাস, ভাগাভাগি? কারণ আমাদের রয়েছে মানসিকতার গণ্ডি। সন্তান-পরিজন যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, কাজ নিয়ে ছুটছেন নিরন্তর, তখন একজন বয়স্ক মানুষ সম্পূর্ণ একা। তাদের স্বাধীনতা কোথায়? সেই প্রশ্নই তুলবে 'গণ্ডি', ছুঁয়ে যেতে চাইবে একাকিত্বের ব্যথা, ভেঙে দিতে চাইবে বয়স্ক নারী-পুরুষের জীবনের পরিচিত প্রবাদ। রোমান্টিক কমেডি ঘরানার 'গণ্ডি' ছবির প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সব্যসাচী চক্রবর্তী ও বাংলাদেশের সুবর্ণা মুস্তাফা।


একসময় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর চরিত্রটি পাকাপাকিভাবে পেয়ে যান সব্যসাচী চক্রবর্তী। বহুমাত্রিক চরিত্রে অভিনয় করলেও ফেলুদা হিসেবেই দুই বাংলায় তুমুল জনপ্রিয় তিনি। অন্যদিকে সুবর্ণা মুস্তাফাও অভিনয় জগতের কিংবদন্তি। 'গণ্ডি' ছবির প্রচারের অংশ হিসেবে এ দুই প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী গত মঙ্গলবার সকালে এসেছিলেন সমকাল কার্যালয়ে। শুরুতে তারা দু'জনই কৃতজ্ঞতা জানালেন ফাখরুল আরেফীন খানকে এমন একটি দারুণ গল্পের সিনেমায় সুযোগ দেওয়ার জন্য।সব্যসাচী চক্রবর্তী তো রীতিমতো বিনয়ের অবতার! তিনি জানালেন, সিনেমাটির গল্পই কেবল তাকে টেনেছে তা নয়, সিনেমাটি নিয়ে ফাখরুল আরেফীন খানের স্বপ্নও তাকে ভীষণ টেনেছে। অনেকটা একই কথা বললেন সুবর্ণা মুস্তাফাও। সব্যসাচী চক্রবর্তী আরও বললেন, 'আরেফীন যে আমাকে এ ছবিতে অভিনয় করানোর কথা ভাবলেন, সেটাই আমার আশ্চর্য লেগেছে। বয়স ছাড়া আর কোনো কিছুর সঙ্গেই বোধ হয় এ ছবির চরিত্র 'আজগর' আর আমার কোনো মিল নেই। আমি হয় গুণ্ডা, নয় পুলিশ, নয় গোয়েন্দা- এ রকম চরিত্রে অভিনয় করেই অভ্যস্ত। আমার অভিনয় জীবনের শুরুতে এ রকম কিছু চরিত্রে অভিনয় করেছি। পরে আমার চেহারার কারণে কেউ আর আমাকে এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করাতে চাননি। গত বছরের জানুয়ারিতে আরেফীন যখন আমার বাসায় গিয়ে ছবির গল্প শোনান, তখনই রাজি হয়ে যাই। এ ছবির গল্পে রয়েছে আমাদের জীবনের অনেক বিষয়, যা মানুষকে ভাবাবে বলে আমার মনে হয়।'

সুবর্ণা মুস্তাফা বললেন, 'এ ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এর গল্প। আরেফীন যখন গল্পটা আমাকে বলেন, হাঁ করে গল্পটা শুনে রাজি হয়ে গেলাম। পরে যখন শুনলাম আমার প্রিয় একজন অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তীও এতে অভিনয় করছেন; তখন বিষয়টি সোনায় সোহাগার মতো হয়ে গেল। আমার সহশিল্পী যদি সব্যসাচী চক্রবর্তী হন, তাহলে অভিনয় এমনি এমনি ভালো হয়ে যায়।' ছবিতে সুবর্ণা ও সব্যসাচীকে নেওয়ার পর পরিচালকের খাটতে হয়েছে আরও অনেক বেশি। কারণ এই দুই অভিজ্ঞ অভিনয়শিল্পীকে কীভাবে ক্যামেরায় বন্দি করলে সবচেয়ে ভালো হবে, সেই পরিকল্পনাতেই গিয়েছে অনেকটা সময়। এরপর গত বছরের মার্চে শুরু করেন ছবিটির দৃশ্যধারণ। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ভ্যালেন্টাইন পার্ক, ইল ফোর্ড, ইস্ট চ্যাপেল, এন ফিল্ড, পিকাডেলি সার্কাস ছাড়াও ঢাকা ও কক্সবাজারের বেশ কয়েকটি লোকেশনে চিত্রায়িত হয়েছে 'গণ্ডি'। কেমন ছিল শুটিংয়ের সময়ের দিনগুলো? প্রথমেই সব্যসাচী বলেন, 'দারুণ লেগেছে। বাংলাদেশে এত সুন্দর জায়গা আছে, যা এই ছবির কাজে না এলে আবিস্কারই করতে পারতাম না। বিশেষ করে কক্সবাজারের কথা বলব। এ ছবিতে অভিনয় না করলে এই জায়গাটি দেখা মিস হয়ে যেত। বেড়ানোর জন্য দারুণ একটি জায়গা! যদিও শুটিংয়ের কারণে সেভাবে ঘোরার সুযোগ হয়নি। আর সুযোগ এসে থাকলেও সেটির সদ্ব্যবহার করিনি। কারণ এখানে আমি এতটাই পরিচিত, চারদিকে মানুষ ঘিরে ধরেছে, ছবি তুলছে, অটোগ্রাফ চাইছে। আমাকে যেতে হলে কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হতো। তবে শুটিংয়ের ফাঁকে কয়েকটি বিচে গিয়েছি, সাম্পানে চড়েছি, বিচ বাইক চালিয়েছি। শুধু স্পিডবোট আর প্যারাসাইক্লিং হয়নি। সেগুলো তোলা রইল। যদি কোনোদিন সুযোগ হয় তাহলে হবে।' তার এ কথা শুনে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, 'এখন হয়নি তো কী হয়েছে? আপনি আবার যখন আসবেন তখন হবে।'

কিছুদিন আগে ইউটিউব ও ফেসবুকে প্রকাশ পেয়েছে 'গণ্ডি' ছবির ট্রেইলার। সেখানে দেখা যায় সব্যসাচী চক্রবর্তী আর সুবর্ণা মুস্তাফার সমুদ্রতীরে হাঁটাহাঁটি। ট্রেইলারের একপর্যায়ে, সব্যসাচী চক্রবর্তী খুব আক্ষেপ নিয়ে বলছেন, 'এই বন্ধুত্ব, আড্ডা, গল্প... এগুলো কি শুধুই তোমাদের? আমাদের কি শুধুই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা?' এই একটি কথাই বলে দেয় অবসরে থাকা মানুষের জীবন কতটা নিঃসঙ্গতায় ভরা। এরপর সব্যসাচীর নাতনি আরহা তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল জটিল এক প্রশ্ন। 'বন্ধু' আর 'ভালো বন্ধু'র ভেতর পার্থক্য কী? তবে দাদুর উত্তর দেওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায় ছবির এক মিনিট ৪০ সেকেন্ডের ট্রেলার। যা দেখে আন্দাজ করা যায়, সব্যসাচীর জীবনে সুবর্ণা এমন একজন বন্ধু, যার সঙ্গে নিঃস্বার্থভাবে সময় কাটানোর পাশাপাশি মনের ঝাঁপি খুলে গল্প করা যায়। কিন্তু সমাজ ও পরিবারের মানুষেরা কীভাবে নেবেন তাদের এই বন্ধুত্ব? গত ২৪ জানুয়ারি এই ট্রেলার মুক্তির পর এ পর্যন্ত দেখা হয়েছে কয়েক লক্ষবার।

দু'জন দু'জনের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, 'এবারই প্রথম তার সঙ্গে অভিনয় করলাম। আমাদের দু'জনের কাজের প্রক্রিয়া প্রায় একই রকম ছিল। দু'জনই জানি, আমাদের কী কী করতে হবে। ফলে অ্যাকশন আর রি-অ্যাকশন নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয়নি আমাদের কারোরই।' সুবর্ণাকে নিয়ে সব্যসাচী বলেন, 'উনি আমার চেয়ে অভিজ্ঞতায় অনেক সিনিয়র। ব্যক্তি সুবর্ণাও ভীষণ ভালো একজন মানুষ। তাকে ভীষণ রেসপেক্টেবল লেগেছে। সুবর্ণা শুধু একজন ভালো অভিনেত্রীই নন, রাজনৈতিক নেত্রীও বটে। এটা কি চাট্টিখানি কথা!'

ভালো শিল্পী হতে গেলে নাকি ভালো মানুষ হতে হয়। সব্যসাচী আর সুবর্ণা মুস্তাফার কথার মধ্যে সেই বিনয় স্পষ্ট। মানুষের ইচ্ছা-স্পৃহা, সততা দেখে তারা মিশে যেতে পারেন যে কারও সঙ্গে। যেমন মিশে গেছেন গণ্ডি পরিবারের সঙ্গেও। তারা দু'জনই কথার ফাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, গণ্ডি পেরিয়ে আমরা যদি হলে গিয়ে সিনেমাটি না দেখতে পারি, তাহলে পরে আর সিনেমা নির্মাণে উৎসাহী হবেন না প্রযোজক।

ফলে 'গণ্ডি' পেরোবে 'গণ্ডি'... সে কথা আর বলার অবকাশ রাখে না। এই 'গণ্ডি' স্থাপনাগত 'গণ্ডি' বা দেশের 'গণ্ডি' নয়। মনোজগতের 'গণ্ডি' পেরোনোর কথা বলেছেন পরিচালক। বলেছেন 'ফ্রেন্ডশিপ উইদাউট বাউন্ডারি'র কথা। বলেছেন বন্ধুত্বের নেই কোনো বয়স।

আরও পড়ুন

×