চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়ে মৃণাল সেন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন এই ছবিতে

ছবি: সংগৃহীত
অপর্ণা সেন
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ১৫:৩৫ | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২৪ | ১৬:৩৮
অস্থির এক সময়ে সৃজিত মুখার্জির ‘পদাতিক’ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। একদিকে আরজি কর-কাণ্ডে এলোমেলো পশ্চিমবাংলাসহ পুরো ভারত। অন্যদিকে বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনীতি। এমন পরিস্থিতিতে ‘পদাতিক’ দেখে মনটা ভরে গেল ভালোবাসায়। এক নতুন সৃজিতকে খুঁজে পেলাম ‘পদাতিক ২০২৪’-এ।
সৃজিতের আগের সিনেমাগুলোতে নতুন নতুন চমক পেয়েছি, পেয়েছি চাকচিক্য, অভিনবত্ব, টেকনিকের খেলা। কিন্তু এতটা গভীরতা কোথায় ছিল এতদিন? ভালো সিনেমার প্রতি, পূর্বসূরিদের কাজের প্রতি, পরিচালকের আন্তরিক ভালোবাসা জড়িয়ে রয়েছে এই সিনেমার পরতে পরতে। মৃণাল সেনের সিনেমা ও জীবন নিয়ে সৃজিত গভীর গবেষণা করেছেন এবং তার চেয়েও বড় কথা, তার সারমর্ম অন্তরে উপলব্ধি করেছেন, ‘পদাতিক’ তার প্রমাণ। পদাতিক এখানে মৃণাল সেন, পদাতিক এখানে সৃজিতও। তাই ‘পদাতিক’ সিনেমার সার্থকনামা।
মৃণাল সেনের ছবির ভাষা চিরাচরিত গল্প বলার ভাষা ছিল না। সৃজিতের ‘পদাতিক’-এর ভাষাও চিরাচরিত নয়। চমৎকার সম্পাদনায় বারবার মৃণাল সেনের জীবনালেখ্যর মধ্যে ফিরে এসেছে তারই ছবির দৃশ্য।
আমার বিশেষভাবে ভালো লেগেছে একটি সিকোয়েন্স, যাতে মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ এবং সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির দৃশ্য ইন্টারকাট করে দেখানো হয়েছে সমসময়ের দুই মহীরুহ সমান্তরালভাবে কী ধরনের কাজ করছেন। তবে একটা কথা, মন দিয়ে দেখতে হবে ছবিটি। যারা মৃণাল সেনের বা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের হয়তোবা এঁদের ছবিগুলো আবার দেখে কিছুটা হোমওয়ার্ক করে নিতে হতে পারে। নয়ই বা কেন? আসলে আমরা আজকাল বড় অলস হয়ে পড়েছি দর্শক হিসেবে, ইনস্ট্যান্ট কফির মতো চটজলদি দর্শনেই ইনস্ট্যান্ট বিনোদন পেতে চাই। কিন্তু ভালো ছবি অনেক সময় তার চেয়ে বেশি মনোযোগ দাবি করে। এই ছবিটি সেই ধরনের।
খুব ভালো লাগল মৃণাল আর সত্যজিতের সম্পর্কের দিক। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও দ্বন্দ্ব, বিতর্ক ও বন্ধুত্ব সাবলীলভাবে ধরা পড়েছে। যে দৃশ্যে শোকাচ্ছন্ন দু’জনেই হাসপাতালে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সদ্যপ্রয়াত ঋত্বিক ঘটকের মরদেহের পাশে, সেখানে তিনজন লিজেন্ডের একত্র উপস্থিতি, সিনেমাপ্রেমী আমার চোখে জল এনে দিয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিল কাদের হারিয়েছি আমরা! চমৎকার লাগল, গীতা এবং মৃণালের দাম্পত্যজীবনের ওঠাপড়া, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, অভিমানে পথচলা যেমন বাস্তব, তেমনই মধুর।
অভিনয় এই ছবির মস্ত বড় সম্পদ। বিশেষ করে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়ে মৃণাল সেন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি মনামীও খুবই বিশ্বাসযোগ্য গীতা সেনের চরিত্রে। চঞ্চলের কথা বিশেষভাবে বলছি, শুধু তাঁর চেহারায় মৃণালের একটা আদল খুঁজে পাওয়া যায় [যে আদলকে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছেন পরিচালক] বলেই নয়; চঞ্চলের উপস্থিতি এতটাই জোরালো যে, যে কোনো চরিত্রেই তিনি ভালো অভিনয় করবেন। মৃণাল সেনের কণ্ঠস্বর, তাঁর বসার ভঙ্গি, দাঁতের ফাঁকে পাইপ ধরে তাকাবার ধরন, সবই সম্পন্ন হয়েছে আপাত অনায়াস দক্ষতায়। কিন্তু আমরা সবাই জানি, প্রকৃতপক্ষে অন্য একজন মানুষকে আত্মস্থ করাটা ঠিক কতটা আয়াসসাধ্য। তাই পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য মৃণাল সেন হয়ে ওঠার জন্যে চঞ্চলকে কুর্নিশ জানাই। আশা করব, তিনি পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করবেন।
‘পদাতিকে’র প্রোডাকশন ডিজাইনার তথা শিল্পনির্দেশক তন্ময় চক্রবর্তীও বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন। মৃণাল সেনের বিভিন্ন সময়কার বাসস্থান, সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত বসার/পড়ার ঘর, কফি হাউসের [ইন্ডিয়া কফি হাউস] পরিবেশ, সবটাই সযত্ননির্মিত। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর আবহসংগীত এবং গানের সুর মনে অনুরণন তুলতে থাকে ছবি শেষ হয়ে যাবার অনেকক্ষণ পরেও। সোমনাথ কুন্ডুর মেকআপ বরাবরের মতোই দারুণ। শুধু মৃণাল এবং গীতার বেশি বয়সের চেহারা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।
২ ঘণ্টা ৬ মিনিটের মধ্যে একটা পুরো জীবনকে তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। বিশেষ কিছু মুহূর্ত চয়ন করে দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল সেই জীবনের সারাংশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন সৃজিত। শুধু সেই জীবনের ইতিহাস নয়, তার উদ্ভাসও পেলাম এই ছবিতে। বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে, রাস্তায় সেই পরিচিত ভঙ্গিতে বসা মৃণাল সেন যখন সেই পরিচিত ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলেন, ‘কাট!’ তখন বাহবা দিয়ে বলতেই হয় যে, এর চেয়ে মানানসই শেষ আর কিছু হতে পারতো না। তাহলে কি খুঁত ছিল না তাহলে ‘পদাতিকে’? অবশ্যই ছিল। তবে সে কথা এখানে আলোচনা করতে চাই না। কারণ, আমি চাই সবাই ছবিটা দেখুন। এটুকু বলতে পারি যে, কিছু অংশ ভালো না লাগলেও, যা ভালো লেগেছে, তার অভিঘাত অনেক বেশি।
লেখক: অভিনেত্রী ও নির্মাতা
- বিষয় :
- অপর্ণা সেন
- চঞ্চল চৌধুরী