নিবন্ধ
জামালপুর টু লিভারপুল

শামীম আজাদ
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০
ট্রেনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে বুঝি ট্রেনে নয়, এই রাতে ভেসে চলেছি এক অত্যাশ্চর্য জৈব জাহাজে।
ট্রেনের ডাক, জাহাজের ডাক, ডাহুকের ডাক আর কবির কশিদার ডাক আমার কাছে শুধু আহ্বান বা হাতছানি নয়, তার চেয়েও অন্য কিছু। এ ডাক আসে স্বপ্নে স্বপ্নে আর আমাকে যুগপৎ উতলা ও বিষণ্ণ করে তোলে। আমি স্বপ্নস্পৃষ্ট হয়ে এদিক-ওদিক পড়ি ও পথ খুঁজি পালাবার।
ছোটবেলায় জামালপুরে বিশাল এক হিমসাগর আমগাছের নিচে তিমি মাছের পিঠরঙা টিনশেড একটি বাড়িতে থাকতাম। পাশেই পাবলিক লাইব্রেরির পেছনে ছিল শীর্ণ ব্রহ্মপুত্র। নদী তো নয়, সে ব্রহ্মপুত্রের শুকনো কুঁড়ি। রাতের বেলা জলের শব্দে জেগে উঠে জল খুঁজে পেতাম না। কিন্তু বুঝতাম হাওয়াটা ঠিক আমার বুকের কাছ থেকেই আসছে। তেরো-চৌদ্দ বছরের বালিকা! সে সময় কতদিন ঘুম ভেঙে সন্তর্পণে পাশে শোয়া বালক অগ্রজকে টপকে মেঝেতে পা ফেলেই সদ্য আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পাওয়া গেরুয়া কাপড়ের মলাট মোড়া একমাত্র কবিতার বই 'সঞ্চয়িতা' খুলে ধরেছি। কিন্তু কেন জানতাম না।
জামালপুর গার্লস স্কুলের কোনো গানের শিক্ষক ছিল না। কিন্তু একহারা গড়নের মোখলেস স্যার আমাদের দিয়ে কোরাসে কলতান তুলতে ওই হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য সিংজানি বাজারে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। চাদর পেতে খুচরো পয়সা, চাল, ডাল, লবণ তুলতে তুলতে 'ঝঞ্ঝা এলো বন্যা এলো ভাসল ক্ষেতের ধান/ করাল গ্রাসে শেষ হলো ওই লাখো ভায়ের প্রাণ' গাইতে গাইতে করাল গ্রাস কী- তা বোঝার চেষ্টা করতাম। জানতাম না কোথায় বন্যা। করাল গ্রাস শব্দের অর্থও বুঝিনি। শুধু বুঝতাম বারবার একই গান গাইতে গাইতে চাদরটাই পাল হয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলত আমাকে। এ শিল্পঘোর চলছে সেই শৈশব থেকেই। এরও আগে ভোরে ফেনীর রেললাইনের পাশ দিয়ে আব্বার হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে দেখেছি আমারই বয়সের কিশোরী সেখান থেকে কয়লার টুকরো কুড়িয়ে নিচ্ছে। বাসায় ফিরে কেতলিতে চা জ্বাল দেওয়ার আম্মার কয়লার চুলার পাশে টাল করা কালো কয়লা। সন্ধ্যাবেলা চুলার গনগনে লাল কয়লা দেখে আমারই মতো লালচুলো সে টোকাই মেয়েটির কথা মনে হতো। লাল আগুন ও লাল চুলের ভাষা একাকার হয়ে যেত।
ট্রেনগুলো দেখতে ছিল যেমন তেমন। কিন্তু এমন যে বিকট হুংকার দিত তাতে একবার ঘুম ভেঙে বিছানা থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম আরকি! ছোট ছিলাম বলেই সবেমাত্র পৃথিবীর শব্দ শনাক্ত করতে শুনতে শুরু করেছি। কানের কাছে শব্দ দুলে দুলেও বাণী নির্মাণ করত। ট্রেনের ঝিরঝির ঝিকঝিক কত কথা বলত। জানালায় মাথা হেলান দিতে সুর করে তা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গেলে আব্বা মাথার ওপরে বাংক বেড হোল্ড অলে শুইয়ে দিতেন। গরমের ছুটিতে সিলেটে গ্রামের বাড়ি যাবার পথে ভোররাতে ট্রেনের বিকট চিৎকারে ঘুম ভাঙলেই 'চা গ্রম চা গ্রম' ধ্বনি শুনে বুঝতাম আখাউড়া এসে গেছি। আম্মার সঙ্গে 'জানানা' কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে দেখতাম কোথা থেকে আব্বা এসে দ্রুত ফ্ল্যাস্কে চা ভরে 'অ্যাই ডিম অ্যাই ডিম'ওলার কাছ থেকে ডিম ও লবণ আর লোফওলার কাছ থেকে ছোট ছোট মিষ্টি রুটি কিনে নিচ্ছেন। আমাদের কামরার দরজায় মেয়েদের ছবি দিয়ে লেখা জানানা। আরও কিছুদিন পরে তা 'মহিলা' হলো। কেন আমরা 'জানানা' ছিলাম? কেন 'মহিলা' ছিলাম না- সেটা বুঝতে বুঝতে দেহ থেকে একথোকা রক্তজবা ভেঙে গেল। আর রেহেলের ওপর মাথা রেখে অর্থ না জেনে কিছু বাণী মুখস্থ করে করে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করি।
ছোটবেলা কত সরল সুখী থাকে মানুষ! কিন্তু মানুষ থেকে নারী হয়ে দেখি শৈশবের জম্পেশ জামালপুরের বিকল্প যৌবনে ভিন্ন অর্থ নিয়ে এলো। অবাঙালি প্রিন্সিপাল একুশেতে দেয়াল টপকে বাইরের মিছিলে গেছি বলে কুমুদিনী হল থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। পরীক্ষার আগে আর সেখানে প্রবেশাধিকার রইল না। কলেজের সরস্বতী পূজায় বীণাপাণির পদতলে দেখি ববকাট চুলের শর্বরীদি রেখেছেন সঞ্চয়িতা ও শেকসপিয়রের রচনাসমগ্র। সেই থেকে এলো আরেক ভাষা। আজ এই পরিণত বয়সের এই বিদেশ ভূখণ্ডের লীলাময় লিভারপুল হয় না। চার্চের চিমনিতে তুষার জমা হলেও তৈরি হয় না কোনো রহস্য।
কিন্তু আমি জামালপুর টু লিভারপুল এসে গেছি! আস্তে আস্তে উপলব্ধি হয়েছে- এর একটা ভাষাধ্বনি যেমন আছে, তেমনই একটা যাত্রাধ্বনিও আছে। সরু এঁকেহেঁকে যাবার মধ্যে ছিল লিভারপুল, হার্টলিপুল, স্যান্ডারল্যান্ড, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, মৌলভীবাজার স্টেশনগুলো। আর আমার হিউম্যান স্টেশনগুলোর মধ্যে ছিল নারায়ণগঞ্জের ফনী কাক্কার নিতাইগঞ্জের বাসার ফুলকো লুচি তরকারি ও স্মৃতিময়দা'র কবিতা আবৃত্তি। সরদার জয়েনুদ্দিনের অতিথি বক্তৃতা। সেই থেকেই তৈরি হয়েছে আমার বহুভাষিক ও বহুজাতিক ভাষা মানচিত্র।
এতে হাত বাড়ালেই কিংস ক্রস স্টেশনে স্নান, সাবরিনার শার্লটের বাড়ির পাশের একাকী যাত্রীছাউনির পোস্টার। ডার্লিংটনের ডান্ডিলায়ন, সান্ডারল্যান্ডের সুরভিত পোয়েট্রি পাব, নিউ ক্যাসলের নতুন ব্রিজ ও লিভারপুলের হারানো লাল সুটকেসের কথা। থাকবে আলো-আঁধারে যাওয়া-আসা। কেবল ভালোবাসা।
কত মানুষ স্বপ্নে ও জাগরণে আমার শিল্প ট্রেনসঙ্গী হয়ে কবিতা কথকতা হয়েছেন! আলোর অজগরটি চলে গেলে ভাবি এইসব।
০২.
ইহকালে উচ্চবিত্তের চাকরি, ভালো অবস্থান, বাড়তি সুযোগ-সুবিধা হয় ইংলিশ জানলে। কিন্তু ইংরেজি শেখা ব্যয়বহুল ও বহু কষ্ট। কিন্তু কোনোমতে শিখতে পারলেই তো কেল্লাফতে! তাই বহু কষ্ট করে হলেও আমরা যত্ন নিয়ে ফাঁকি না দিয়ে তা শিখি। শিখি বিদেশি ইংলিশ ভাষা।
দ্বিতীয় যে ভাষা শিখি তা আরবি। এটাও আরেকটি বিদেশি ভাষা। আরবি শিখি পরকালের ভয়ে। যদি বেহেশত না পাই! যদি গরম শিক ছ্যাঁকা দেয়! আগুনে পোড়ার ভয়ে বা হুরি পাবার লোভে কষ্ট করে প্রায় না বুঝে হলেও শিখি আরবি ভাষা।
কিন্তু কোনো ভয়, মোহ, ব্যয় ও কষ্ট ছাড়া না শিখেই অনায়াসে পেয়ে যাই বাংলা বুলি। এর জন্য আমাদের কোনো যোগ্যতা লাগে না। শুধু বাংলা মায়ের গর্ভে জন্ম নিলেই হয়।
তাই বলে কি এ তিনটি ভাষার মধ্যে দেশি ভাষা বাংলার দাম এত কম? বাংলাকে স্থান দিই সবচেয়ে পরে, অনাদর করি, শুদ্ধ করে বলার বা লেখার জন্য ব্যয় বা অধ্যবসায় করি না। এমনকি বিদেশে গেলে তাকে আর পাতে তুলি না, ভুলে যাই। এদিকে দেশি ভাষা দেশে থেকে বলতে গেলেও লজ্জা পাই বা জগাখিচুড়ি করে বলি! কেন!
এবার নিজের কথা। আমি বাংলাদেশের সিলেটি পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলে অনায়াসে পেয়েছি সিলেটি বুলি (বাংলা)। আর সিলেটি পরিবারের রীতি অনুযায়ী তার চর্চা অব্যাহত রাখতে হয়েছে।
আমরা সিলেটিরা প্রমিত ভাষা শিখি স্কুলে। ছোটবেলা আমাদের বাসার নিয়ম ছিল- 'স্কুলো গিয়ে ভাষায় মাতো কুনু অসুবিদা নাই, কিন্তু বাসাত মাতবায় সিলোটি।' এখানে 'ভাষায়' বলতে প্রমিত বাংলা বুঝতে হবে। ঘরের বাইরে সব জায়গায়ই তো 'ভাষা' মানে সে দেশের জাতীয় ভাষা। ঘর থেকে বেরোলেই যা পাওয়া যায় চলাফেরা, দেখাশোনায় সব জায়গায় তা ছড়ানো। কিন্তু মায়ের জবানটা ধরে রাখতে হবে চেষ্টা করেই।
বাইরের পৃথিবীতে চলার জন্য শিখেছি প্রমিত বাংলা। স্কুলে ইংরেজি শিখেছি বাংলা মাধ্যমে। স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে স্কুল ফাইনাল বাংলা মাধ্যমেই। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর সবই পড়েছি সেই বাংলা মাধ্যমেই। ইংরেজি ছিল সাবসিডিয়ারি। অথচ বিলেতের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজি বলে বিগত তিন-তিনটি দশকের ওপরে 'করে খাচ্ছি' ইংরেজিতেই। ভাবা যায়!
যায়। মাতৃভাষা দিয়েই বাদবাকি সব জ্ঞান আহরণ করেছি বলেই। ১৯৯০ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছেড়ে যখন শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে বিলেতের স্কুলে পড়াতে আসি, তখন অনেকের সঙ্গে আমিও ভেবেছি আমি বাংলা পড়াতে যাচ্ছি। এসেই বুঝি তা নয়। পড়াতে হলো ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞান। এবং তা ইংরেজি মাধ্যমে।
মনে পড়ে এ শীতের দেশে জীবনের লড়াই করতে করতে করতে কাজ শেষে ক্লান্ত আমি বাঙালিপাড়া থেকে বাজার করে ফেরার সময় 'পশ' কোনো বাঙালির সঙ্গে আলাপ হলেই যখন বলতাম-
আমি লন্ডনের স্কুলে পড়াই।
বিস্ময়ে তাকাতেন।
-কী পড়ান?
আমি বুঝতাম, দেশ থেকে শিক্ষা সমাপন করে আসা আমাদের মতো মানুষের দ্বারাও যে বিলেতের শিশুদের ইংরেজিতে পড়ানো সম্ভব, তা অনেকে ভাবতে পারেন না। আমার এক মাতুল তো বলেই বসলেন- তুই ইতা বাদুয়া বাচ্চাইনতরে পড়াইতে আইসস?
সত্যি, নিজেদের নিয়ে এমন নেতিবাচক ধারণা অন্য কোনো জাতির আছে বলে এখনও জানি না।
-কী পড়ান?
-বাংলা ছাড়া সবই।
-মানে?
আবারও হেসে বলতাম,
-ইংল্যান্ডের প্রাইমারি স্কুলের ন্যাশনাল কারিকুলাম (ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞান)।
-অ!
বুঝতাম মনে মনে ভাবছেন ইংলিশদের হলোটা কী? আসলেও হ্যাঁ তাই। ক্রস কারিকুলারসহ আর যা যা আছে তার সবই পড়িয়েছি আমার দেশ বাংলাদেশ থেকে অর্জিত বিদ্যাতেই।
তো ফিরে আসি পেশাগত জীবনে। দেশি বিদ্যেয়ই কী করে কী করলাম! এদের শর্ত অনুযায়ী, স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি বিলেতি শিক্ষকতার সনদের জন্য পড়লাম, পাস করলাম এবং পড়ানোর নানান পদ্ধতি আয়ত্ত করলাম।
এর বাইরে সমান্তরালভাবে বাড়তি সময়ে লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র স্থাপন করলাম, সেখানে বাংলা স্কুল চালু করলাম শেলী, মিনারা, সীমা, আব্দুল কাদের এদেরকে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বাঙালি ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা শেখানোর প্রশিক্ষণ দিলাম। আসলে বাক্সটন স্কুলে, ইংরেজি ভাষা যে আধুনিক প্রক্রিয়ায় শেখাতাম, তারই বাংলা ভার্সনের একটি ছোট্ট কারিকুলাম করে নিয়েছিলাম। আর যাদের যুক্ত করেছিলাম তারাও মূলধারার স্কুলে ক্লাসরুম সহকারী বা শিক্ষকই ছিলেন। তাই ব্যাপারটা আয়ত্ত করতে তাদের দেরি হয়নি। ভাষা শিক্ষায়- স্পিকিং, লিসেনিং, রিডিং ও রাইটিংয়ের মধ্যে আমি জোর দিয়েছিলাম বাংলা বলার প্রতি। বিদেশে সেটাই প্রথম দরকার।
০৩.
এখন বলি আমার তৃতীয় ধারার কথা। এ দেশে আমার সৃষ্টিশীলতা কী করে ধরে রেখেছি। জানি বাংলাটা তো জন্মগত অনায়াসেই পাওয়া, তা অব্যাহত রাখলাম দেশের বাংলা কাগজে কবিতা, গদ্য ও কলাম লেখায়। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ভোরের কাগজ, প্রথম আলোর প্রবাস পাতায় লেখা ও কলাম ছাড়াও ২০০৭ (যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র দাঁড়িয়ে যাবার পর) ফিরে এলাম। আগামী থেকে বেরোল 'ওম'। সেই থেকে আজ অবধি গ্রন্থও প্রকাশ করে যেতে থাকলাম নিয়মিত। এবার যোগ হলো ইংরেজিও। দেশ থেকে বহুদূরে থেকেও নাটক, অনুবাদ, কবিতা, গল্প, রচনা, শিশুগ্রন্থ ও সম্পাদনা মিলিয়ে তার সংখ্যা চল্লিশ হতে চলেছে। ফলে 'দেশের শামীম আজাদ আর মরল না'।
তবুও সৃজনের ডানা ঝাপটানো বন্ধ হয় না। নানান মূলধারার সংগঠনে দরখাস্ত করে করে কাজ পেয়ে পেয়ে যেতেই থাকলাম। দিলাম স্কুলের দিন কমিয়ে। হয়ে গেলাম ফ্রিল্যান্স পার্টটাইমার। 'অ্যাপলস অ্যান্ড স্নেকস' নামের আর্ট সংগঠনে লন্ডন আর্টস কাউন্সিলের বৃত্তি অর্জন করে রাত ও ঘুম ক্ষয় করে কবিতা ও গল্প বলাকে ক্লাসরুমে ইংরেজি শেখানোর উপায়ের ওপর স্নাতক শেষ করলাম। প্রতিযোগিতামূলক আবেদনে ও সাক্ষাৎকারে বৃত্তি পেলাম আর্টস কাউন্সিল থেকেই। শুরু হলো স্কুল-শিক্ষকতার পাশাপাশি আরেক অধ্যায়।
এরই মধ্যে ইংরেজি কবিতা লিখতে, গল্প বলতে গিয়ে উপলব্ধি হয়ে গেছে যে এ দেশের ইংরেজিভাষীদের সমান ইংরেজি আমার না। কর্মপ্রক্রিয়া, প্রকরণ, প্রশিক্ষণবিদ্যায় আমি সমকক্ষ। আরে ওদের মাতৃভাষার সঙ্গে আমি কী করে পাল্লা দেব? আয় দেখি বাংলা শিখেও আমার সঙ্গে বাংলায় পারিস কিনা? এক বুদ্ধি বের করলাম, সে হলো ট্যাক্ট। আমি আমার পরিবেশনে বাংলাদেশের অশ্রুত বিষয়বস্তু ও গল্প নিয়ে এলাম। এবং সেটাই হয়ে গেল আমার ট্রেন্ড। আপনারাও দেখেছেন আমার চেয়ে বিস্তর ভালো ইংরেজি জানা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা বহু খ্যাতনামা গল্প ও উপন্যাস লেখক (যাদের ভিন্ন বংশধারী) তাঁরা তাই করেই আজ বিশ্ববিখ্যাত। তাঁরা লেখেন অভিবাসী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাঁদের সবারই কাজ 'দেশের গল্প' নিয়ে। আমিও আর কোনো ব্যতিক্রম হলাম না। কেউ পোড়ানো দেখে শেখে, কেউ পুড়িয়ে। আমার হলো দুটোই। রান্না করতে লাগলাম বাংলাদেশের সাহিত্যের ব্যাপক ও অব্যবহূত (ইংরেজি বা বিদেশি আর্টস অ্যান্ড লিটারেচারে) কাঁচামাল। সত্যি কথা কী, বাংলার ভালো অনুবাদে এখনও বিরল।
জানি আমাদের সিলেটিদের বাংলা উচ্চারণ অনেকের মনে কৌতুক জাগায়। অনেকে হাসেন। কিন্তু সত্যি বলুন তো, আমরা কি পারি একজন ইংরেজের মতো ইংলিশ বলতে? যদি না এ দেশে তার জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা না হয়। বিলেতের স্কটিশরাও বিলেতি বলে তাদের নিজস্ব উচ্চারণে, নিউ ক্যাসলের মানুষ তারই মতো উচ্চারণে ইংলিশ বলে। কিন্তু এ দেশে ইংরেজির এসব উচ্চারণ নিয়ে কেউ হাসে না। এরা তাদের ওই উচ্চারণেই টিভি উপস্থাপক। মনে পড়ছে আমাদের একজন অত্যন্ত সফল অর্থমন্ত্রীর কথা। তাঁর করা বাজেট নিয়ে যত কথা হতো, তাঁর সিলেটি উচ্চারণ নিয়ে হতো অনেক বেশি। আসলে কী? বিষয় প্রতিস্থাপনই বড় কথা, অর্থ অনুধাবনই আসল কথা। তাতেই রয়ে যায় নিজ সংস্কৃতি, সুষমা এবং নাড়ির টান। এটাই দড়ি, এতেই হয় সব খান খান।
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা পরিবর্তন এলেও দেশটির রাজনীতি এখনও আবর্তিত হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। সে পক্ষে এবং বিপক্ষে (অনুচ্চারিত)। স্বাধীনতার লড়াইয়ের বীজ উপ্ত হয়েছিল ভাষার লড়াই থেকে সেই ১৯৫২-তে। তাই আমরা একটি ভাষিক জনগোষ্ঠী। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন ভাষা বিকৃতি ও হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতি কীভাবে এক ধূম্রজালে পড়ে গেছে! এখন বাংলাদেশের বিয়ের আসরে গেলে আপনি বুঝতেই পারবেন না কোন দেশে আছেন। সে গল্পও আরেক দিন করতে হবে।
আজ আমার কথাতেই ফিরে আসি। আমি যতদূর বা যে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি বা দিতে পেরেছি সে আমার মায়ের ভাষা বাংলা ছিল বলে।
নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম
চির-মনোরম চির-মধুর।
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুরা
ট্রেনের ডাক, জাহাজের ডাক, ডাহুকের ডাক আর কবির কশিদার ডাক আমার কাছে শুধু আহ্বান বা হাতছানি নয়, তার চেয়েও অন্য কিছু। এ ডাক আসে স্বপ্নে স্বপ্নে আর আমাকে যুগপৎ উতলা ও বিষণ্ণ করে তোলে। আমি স্বপ্নস্পৃষ্ট হয়ে এদিক-ওদিক পড়ি ও পথ খুঁজি পালাবার।
ছোটবেলায় জামালপুরে বিশাল এক হিমসাগর আমগাছের নিচে তিমি মাছের পিঠরঙা টিনশেড একটি বাড়িতে থাকতাম। পাশেই পাবলিক লাইব্রেরির পেছনে ছিল শীর্ণ ব্রহ্মপুত্র। নদী তো নয়, সে ব্রহ্মপুত্রের শুকনো কুঁড়ি। রাতের বেলা জলের শব্দে জেগে উঠে জল খুঁজে পেতাম না। কিন্তু বুঝতাম হাওয়াটা ঠিক আমার বুকের কাছ থেকেই আসছে। তেরো-চৌদ্দ বছরের বালিকা! সে সময় কতদিন ঘুম ভেঙে সন্তর্পণে পাশে শোয়া বালক অগ্রজকে টপকে মেঝেতে পা ফেলেই সদ্য আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পাওয়া গেরুয়া কাপড়ের মলাট মোড়া একমাত্র কবিতার বই 'সঞ্চয়িতা' খুলে ধরেছি। কিন্তু কেন জানতাম না।
জামালপুর গার্লস স্কুলের কোনো গানের শিক্ষক ছিল না। কিন্তু একহারা গড়নের মোখলেস স্যার আমাদের দিয়ে কোরাসে কলতান তুলতে ওই হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য সিংজানি বাজারে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। চাদর পেতে খুচরো পয়সা, চাল, ডাল, লবণ তুলতে তুলতে 'ঝঞ্ঝা এলো বন্যা এলো ভাসল ক্ষেতের ধান/ করাল গ্রাসে শেষ হলো ওই লাখো ভায়ের প্রাণ' গাইতে গাইতে করাল গ্রাস কী- তা বোঝার চেষ্টা করতাম। জানতাম না কোথায় বন্যা। করাল গ্রাস শব্দের অর্থও বুঝিনি। শুধু বুঝতাম বারবার একই গান গাইতে গাইতে চাদরটাই পাল হয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলত আমাকে। এ শিল্পঘোর চলছে সেই শৈশব থেকেই। এরও আগে ভোরে ফেনীর রেললাইনের পাশ দিয়ে আব্বার হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে দেখেছি আমারই বয়সের কিশোরী সেখান থেকে কয়লার টুকরো কুড়িয়ে নিচ্ছে। বাসায় ফিরে কেতলিতে চা জ্বাল দেওয়ার আম্মার কয়লার চুলার পাশে টাল করা কালো কয়লা। সন্ধ্যাবেলা চুলার গনগনে লাল কয়লা দেখে আমারই মতো লালচুলো সে টোকাই মেয়েটির কথা মনে হতো। লাল আগুন ও লাল চুলের ভাষা একাকার হয়ে যেত।
ট্রেনগুলো দেখতে ছিল যেমন তেমন। কিন্তু এমন যে বিকট হুংকার দিত তাতে একবার ঘুম ভেঙে বিছানা থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম আরকি! ছোট ছিলাম বলেই সবেমাত্র পৃথিবীর শব্দ শনাক্ত করতে শুনতে শুরু করেছি। কানের কাছে শব্দ দুলে দুলেও বাণী নির্মাণ করত। ট্রেনের ঝিরঝির ঝিকঝিক কত কথা বলত। জানালায় মাথা হেলান দিতে সুর করে তা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গেলে আব্বা মাথার ওপরে বাংক বেড হোল্ড অলে শুইয়ে দিতেন। গরমের ছুটিতে সিলেটে গ্রামের বাড়ি যাবার পথে ভোররাতে ট্রেনের বিকট চিৎকারে ঘুম ভাঙলেই 'চা গ্রম চা গ্রম' ধ্বনি শুনে বুঝতাম আখাউড়া এসে গেছি। আম্মার সঙ্গে 'জানানা' কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে দেখতাম কোথা থেকে আব্বা এসে দ্রুত ফ্ল্যাস্কে চা ভরে 'অ্যাই ডিম অ্যাই ডিম'ওলার কাছ থেকে ডিম ও লবণ আর লোফওলার কাছ থেকে ছোট ছোট মিষ্টি রুটি কিনে নিচ্ছেন। আমাদের কামরার দরজায় মেয়েদের ছবি দিয়ে লেখা জানানা। আরও কিছুদিন পরে তা 'মহিলা' হলো। কেন আমরা 'জানানা' ছিলাম? কেন 'মহিলা' ছিলাম না- সেটা বুঝতে বুঝতে দেহ থেকে একথোকা রক্তজবা ভেঙে গেল। আর রেহেলের ওপর মাথা রেখে অর্থ না জেনে কিছু বাণী মুখস্থ করে করে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করি।
ছোটবেলা কত সরল সুখী থাকে মানুষ! কিন্তু মানুষ থেকে নারী হয়ে দেখি শৈশবের জম্পেশ জামালপুরের বিকল্প যৌবনে ভিন্ন অর্থ নিয়ে এলো। অবাঙালি প্রিন্সিপাল একুশেতে দেয়াল টপকে বাইরের মিছিলে গেছি বলে কুমুদিনী হল থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। পরীক্ষার আগে আর সেখানে প্রবেশাধিকার রইল না। কলেজের সরস্বতী পূজায় বীণাপাণির পদতলে দেখি ববকাট চুলের শর্বরীদি রেখেছেন সঞ্চয়িতা ও শেকসপিয়রের রচনাসমগ্র। সেই থেকে এলো আরেক ভাষা। আজ এই পরিণত বয়সের এই বিদেশ ভূখণ্ডের লীলাময় লিভারপুল হয় না। চার্চের চিমনিতে তুষার জমা হলেও তৈরি হয় না কোনো রহস্য।
কিন্তু আমি জামালপুর টু লিভারপুল এসে গেছি! আস্তে আস্তে উপলব্ধি হয়েছে- এর একটা ভাষাধ্বনি যেমন আছে, তেমনই একটা যাত্রাধ্বনিও আছে। সরু এঁকেহেঁকে যাবার মধ্যে ছিল লিভারপুল, হার্টলিপুল, স্যান্ডারল্যান্ড, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, মৌলভীবাজার স্টেশনগুলো। আর আমার হিউম্যান স্টেশনগুলোর মধ্যে ছিল নারায়ণগঞ্জের ফনী কাক্কার নিতাইগঞ্জের বাসার ফুলকো লুচি তরকারি ও স্মৃতিময়দা'র কবিতা আবৃত্তি। সরদার জয়েনুদ্দিনের অতিথি বক্তৃতা। সেই থেকেই তৈরি হয়েছে আমার বহুভাষিক ও বহুজাতিক ভাষা মানচিত্র।
এতে হাত বাড়ালেই কিংস ক্রস স্টেশনে স্নান, সাবরিনার শার্লটের বাড়ির পাশের একাকী যাত্রীছাউনির পোস্টার। ডার্লিংটনের ডান্ডিলায়ন, সান্ডারল্যান্ডের সুরভিত পোয়েট্রি পাব, নিউ ক্যাসলের নতুন ব্রিজ ও লিভারপুলের হারানো লাল সুটকেসের কথা। থাকবে আলো-আঁধারে যাওয়া-আসা। কেবল ভালোবাসা।
কত মানুষ স্বপ্নে ও জাগরণে আমার শিল্প ট্রেনসঙ্গী হয়ে কবিতা কথকতা হয়েছেন! আলোর অজগরটি চলে গেলে ভাবি এইসব।
০২.
ইহকালে উচ্চবিত্তের চাকরি, ভালো অবস্থান, বাড়তি সুযোগ-সুবিধা হয় ইংলিশ জানলে। কিন্তু ইংরেজি শেখা ব্যয়বহুল ও বহু কষ্ট। কিন্তু কোনোমতে শিখতে পারলেই তো কেল্লাফতে! তাই বহু কষ্ট করে হলেও আমরা যত্ন নিয়ে ফাঁকি না দিয়ে তা শিখি। শিখি বিদেশি ইংলিশ ভাষা।
দ্বিতীয় যে ভাষা শিখি তা আরবি। এটাও আরেকটি বিদেশি ভাষা। আরবি শিখি পরকালের ভয়ে। যদি বেহেশত না পাই! যদি গরম শিক ছ্যাঁকা দেয়! আগুনে পোড়ার ভয়ে বা হুরি পাবার লোভে কষ্ট করে প্রায় না বুঝে হলেও শিখি আরবি ভাষা।
কিন্তু কোনো ভয়, মোহ, ব্যয় ও কষ্ট ছাড়া না শিখেই অনায়াসে পেয়ে যাই বাংলা বুলি। এর জন্য আমাদের কোনো যোগ্যতা লাগে না। শুধু বাংলা মায়ের গর্ভে জন্ম নিলেই হয়।
তাই বলে কি এ তিনটি ভাষার মধ্যে দেশি ভাষা বাংলার দাম এত কম? বাংলাকে স্থান দিই সবচেয়ে পরে, অনাদর করি, শুদ্ধ করে বলার বা লেখার জন্য ব্যয় বা অধ্যবসায় করি না। এমনকি বিদেশে গেলে তাকে আর পাতে তুলি না, ভুলে যাই। এদিকে দেশি ভাষা দেশে থেকে বলতে গেলেও লজ্জা পাই বা জগাখিচুড়ি করে বলি! কেন!
এবার নিজের কথা। আমি বাংলাদেশের সিলেটি পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলে অনায়াসে পেয়েছি সিলেটি বুলি (বাংলা)। আর সিলেটি পরিবারের রীতি অনুযায়ী তার চর্চা অব্যাহত রাখতে হয়েছে।
আমরা সিলেটিরা প্রমিত ভাষা শিখি স্কুলে। ছোটবেলা আমাদের বাসার নিয়ম ছিল- 'স্কুলো গিয়ে ভাষায় মাতো কুনু অসুবিদা নাই, কিন্তু বাসাত মাতবায় সিলোটি।' এখানে 'ভাষায়' বলতে প্রমিত বাংলা বুঝতে হবে। ঘরের বাইরে সব জায়গায়ই তো 'ভাষা' মানে সে দেশের জাতীয় ভাষা। ঘর থেকে বেরোলেই যা পাওয়া যায় চলাফেরা, দেখাশোনায় সব জায়গায় তা ছড়ানো। কিন্তু মায়ের জবানটা ধরে রাখতে হবে চেষ্টা করেই।
বাইরের পৃথিবীতে চলার জন্য শিখেছি প্রমিত বাংলা। স্কুলে ইংরেজি শিখেছি বাংলা মাধ্যমে। স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে স্কুল ফাইনাল বাংলা মাধ্যমেই। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর সবই পড়েছি সেই বাংলা মাধ্যমেই। ইংরেজি ছিল সাবসিডিয়ারি। অথচ বিলেতের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজি বলে বিগত তিন-তিনটি দশকের ওপরে 'করে খাচ্ছি' ইংরেজিতেই। ভাবা যায়!
যায়। মাতৃভাষা দিয়েই বাদবাকি সব জ্ঞান আহরণ করেছি বলেই। ১৯৯০ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছেড়ে যখন শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে বিলেতের স্কুলে পড়াতে আসি, তখন অনেকের সঙ্গে আমিও ভেবেছি আমি বাংলা পড়াতে যাচ্ছি। এসেই বুঝি তা নয়। পড়াতে হলো ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞান। এবং তা ইংরেজি মাধ্যমে।
মনে পড়ে এ শীতের দেশে জীবনের লড়াই করতে করতে করতে কাজ শেষে ক্লান্ত আমি বাঙালিপাড়া থেকে বাজার করে ফেরার সময় 'পশ' কোনো বাঙালির সঙ্গে আলাপ হলেই যখন বলতাম-
আমি লন্ডনের স্কুলে পড়াই।
বিস্ময়ে তাকাতেন।
-কী পড়ান?
আমি বুঝতাম, দেশ থেকে শিক্ষা সমাপন করে আসা আমাদের মতো মানুষের দ্বারাও যে বিলেতের শিশুদের ইংরেজিতে পড়ানো সম্ভব, তা অনেকে ভাবতে পারেন না। আমার এক মাতুল তো বলেই বসলেন- তুই ইতা বাদুয়া বাচ্চাইনতরে পড়াইতে আইসস?
সত্যি, নিজেদের নিয়ে এমন নেতিবাচক ধারণা অন্য কোনো জাতির আছে বলে এখনও জানি না।
-কী পড়ান?
-বাংলা ছাড়া সবই।
-মানে?
আবারও হেসে বলতাম,
-ইংল্যান্ডের প্রাইমারি স্কুলের ন্যাশনাল কারিকুলাম (ইংরেজি, অঙ্ক ও বিজ্ঞান)।
-অ!
বুঝতাম মনে মনে ভাবছেন ইংলিশদের হলোটা কী? আসলেও হ্যাঁ তাই। ক্রস কারিকুলারসহ আর যা যা আছে তার সবই পড়িয়েছি আমার দেশ বাংলাদেশ থেকে অর্জিত বিদ্যাতেই।
তো ফিরে আসি পেশাগত জীবনে। দেশি বিদ্যেয়ই কী করে কী করলাম! এদের শর্ত অনুযায়ী, স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি বিলেতি শিক্ষকতার সনদের জন্য পড়লাম, পাস করলাম এবং পড়ানোর নানান পদ্ধতি আয়ত্ত করলাম।
এর বাইরে সমান্তরালভাবে বাড়তি সময়ে লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র স্থাপন করলাম, সেখানে বাংলা স্কুল চালু করলাম শেলী, মিনারা, সীমা, আব্দুল কাদের এদেরকে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বাঙালি ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা শেখানোর প্রশিক্ষণ দিলাম। আসলে বাক্সটন স্কুলে, ইংরেজি ভাষা যে আধুনিক প্রক্রিয়ায় শেখাতাম, তারই বাংলা ভার্সনের একটি ছোট্ট কারিকুলাম করে নিয়েছিলাম। আর যাদের যুক্ত করেছিলাম তারাও মূলধারার স্কুলে ক্লাসরুম সহকারী বা শিক্ষকই ছিলেন। তাই ব্যাপারটা আয়ত্ত করতে তাদের দেরি হয়নি। ভাষা শিক্ষায়- স্পিকিং, লিসেনিং, রিডিং ও রাইটিংয়ের মধ্যে আমি জোর দিয়েছিলাম বাংলা বলার প্রতি। বিদেশে সেটাই প্রথম দরকার।
০৩.
এখন বলি আমার তৃতীয় ধারার কথা। এ দেশে আমার সৃষ্টিশীলতা কী করে ধরে রেখেছি। জানি বাংলাটা তো জন্মগত অনায়াসেই পাওয়া, তা অব্যাহত রাখলাম দেশের বাংলা কাগজে কবিতা, গদ্য ও কলাম লেখায়। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ভোরের কাগজ, প্রথম আলোর প্রবাস পাতায় লেখা ও কলাম ছাড়াও ২০০৭ (যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র দাঁড়িয়ে যাবার পর) ফিরে এলাম। আগামী থেকে বেরোল 'ওম'। সেই থেকে আজ অবধি গ্রন্থও প্রকাশ করে যেতে থাকলাম নিয়মিত। এবার যোগ হলো ইংরেজিও। দেশ থেকে বহুদূরে থেকেও নাটক, অনুবাদ, কবিতা, গল্প, রচনা, শিশুগ্রন্থ ও সম্পাদনা মিলিয়ে তার সংখ্যা চল্লিশ হতে চলেছে। ফলে 'দেশের শামীম আজাদ আর মরল না'।
তবুও সৃজনের ডানা ঝাপটানো বন্ধ হয় না। নানান মূলধারার সংগঠনে দরখাস্ত করে করে কাজ পেয়ে পেয়ে যেতেই থাকলাম। দিলাম স্কুলের দিন কমিয়ে। হয়ে গেলাম ফ্রিল্যান্স পার্টটাইমার। 'অ্যাপলস অ্যান্ড স্নেকস' নামের আর্ট সংগঠনে লন্ডন আর্টস কাউন্সিলের বৃত্তি অর্জন করে রাত ও ঘুম ক্ষয় করে কবিতা ও গল্প বলাকে ক্লাসরুমে ইংরেজি শেখানোর উপায়ের ওপর স্নাতক শেষ করলাম। প্রতিযোগিতামূলক আবেদনে ও সাক্ষাৎকারে বৃত্তি পেলাম আর্টস কাউন্সিল থেকেই। শুরু হলো স্কুল-শিক্ষকতার পাশাপাশি আরেক অধ্যায়।
এরই মধ্যে ইংরেজি কবিতা লিখতে, গল্প বলতে গিয়ে উপলব্ধি হয়ে গেছে যে এ দেশের ইংরেজিভাষীদের সমান ইংরেজি আমার না। কর্মপ্রক্রিয়া, প্রকরণ, প্রশিক্ষণবিদ্যায় আমি সমকক্ষ। আরে ওদের মাতৃভাষার সঙ্গে আমি কী করে পাল্লা দেব? আয় দেখি বাংলা শিখেও আমার সঙ্গে বাংলায় পারিস কিনা? এক বুদ্ধি বের করলাম, সে হলো ট্যাক্ট। আমি আমার পরিবেশনে বাংলাদেশের অশ্রুত বিষয়বস্তু ও গল্প নিয়ে এলাম। এবং সেটাই হয়ে গেল আমার ট্রেন্ড। আপনারাও দেখেছেন আমার চেয়ে বিস্তর ভালো ইংরেজি জানা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা বহু খ্যাতনামা গল্প ও উপন্যাস লেখক (যাদের ভিন্ন বংশধারী) তাঁরা তাই করেই আজ বিশ্ববিখ্যাত। তাঁরা লেখেন অভিবাসী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাঁদের সবারই কাজ 'দেশের গল্প' নিয়ে। আমিও আর কোনো ব্যতিক্রম হলাম না। কেউ পোড়ানো দেখে শেখে, কেউ পুড়িয়ে। আমার হলো দুটোই। রান্না করতে লাগলাম বাংলাদেশের সাহিত্যের ব্যাপক ও অব্যবহূত (ইংরেজি বা বিদেশি আর্টস অ্যান্ড লিটারেচারে) কাঁচামাল। সত্যি কথা কী, বাংলার ভালো অনুবাদে এখনও বিরল।
জানি আমাদের সিলেটিদের বাংলা উচ্চারণ অনেকের মনে কৌতুক জাগায়। অনেকে হাসেন। কিন্তু সত্যি বলুন তো, আমরা কি পারি একজন ইংরেজের মতো ইংলিশ বলতে? যদি না এ দেশে তার জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা না হয়। বিলেতের স্কটিশরাও বিলেতি বলে তাদের নিজস্ব উচ্চারণে, নিউ ক্যাসলের মানুষ তারই মতো উচ্চারণে ইংলিশ বলে। কিন্তু এ দেশে ইংরেজির এসব উচ্চারণ নিয়ে কেউ হাসে না। এরা তাদের ওই উচ্চারণেই টিভি উপস্থাপক। মনে পড়ছে আমাদের একজন অত্যন্ত সফল অর্থমন্ত্রীর কথা। তাঁর করা বাজেট নিয়ে যত কথা হতো, তাঁর সিলেটি উচ্চারণ নিয়ে হতো অনেক বেশি। আসলে কী? বিষয় প্রতিস্থাপনই বড় কথা, অর্থ অনুধাবনই আসল কথা। তাতেই রয়ে যায় নিজ সংস্কৃতি, সুষমা এবং নাড়ির টান। এটাই দড়ি, এতেই হয় সব খান খান।
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা পরিবর্তন এলেও দেশটির রাজনীতি এখনও আবর্তিত হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। সে পক্ষে এবং বিপক্ষে (অনুচ্চারিত)। স্বাধীনতার লড়াইয়ের বীজ উপ্ত হয়েছিল ভাষার লড়াই থেকে সেই ১৯৫২-তে। তাই আমরা একটি ভাষিক জনগোষ্ঠী। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন ভাষা বিকৃতি ও হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতি কীভাবে এক ধূম্রজালে পড়ে গেছে! এখন বাংলাদেশের বিয়ের আসরে গেলে আপনি বুঝতেই পারবেন না কোন দেশে আছেন। সে গল্পও আরেক দিন করতে হবে।
আজ আমার কথাতেই ফিরে আসি। আমি যতদূর বা যে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি বা দিতে পেরেছি সে আমার মায়ের ভাষা বাংলা ছিল বলে।
নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম
চির-মনোরম চির-মধুর।
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুরা
- বিষয় :
- নিবন্ধ
- শামীম আজাদ