ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

নায়কের ছবি

নায়কের ছবি

সত্তরেরর জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

হামিম কামাল

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৩০

“In Calcutta, Mujib would become a close associate of Suhrawardy. Under his political directives, mujib assumed leadership roles to convince his fellow students of the need of separate state for India’s muslims. However, he supported Suhrawardi and Sarat Chandra Bose’s plan of keeping Bangal intact and ...”

পড়ছিলাম ‍Sheikh Mujibur Rahman : The voice of the Vortex গ্রন্থ থেকে, Mujib and his Mentor অধ্যায়টি। লেখার পাশেই রয়েছে প্রবীণ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও নবীন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিখ্যাত আবক্ষ ছবি যে ছবি দেখে বরাবরই মনে হয়েছে, সোহরাওয়ার্দীর চোখ দুটো যেন নৃশংস বর্তমানকে দেখছে। শেখ মুজিবুর রহমানের চোখ দুটো দেখছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। 

The voice of the Vortex সম্ভবত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র আলোকচিত্রভিত্তিক জীবনীগ্রন্থ। Pictorial Autobiography যাকে বলে। এখানে ছবিতে ছবিতে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর কৈশোর, তারুণ্য, উত্তাল আদর্শিক রাজনীতিক জীবন, ক্রমশ গণমানুষের নেতা হয়ে ওঠার দিনলিপি যেন চিত্রিত। আছে ছয় দফা, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, নতুন ভূখণ্ড বাংলাদেশের উত্থানপর্বের ঐতিহাসিক চিত্র। আছে তাঁর স্বল্প অথচ যশস্বী কূটনৈতিক জীবন, সাহিত্য-সারস্বত ভুবনের সঙ্গে তাঁর সখ্য,  শ্যামল পরিবারজীবনের মিষ্ট, ভগ্ন কিছু অংশ ও সবশেষে, রক্তাক্ত জীবন-অবসান। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এত বেশি দুর্লভ ছবির সন্নিবেশ এর আগে কোনো গ্রন্থে ঘটেছে বলে জানা নেই। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে আহত সহযোদ্ধাকে নিয়ে চিকিৎসার্থে ছুটছেন, অস্থির দাঁড়িয়ে আছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর চৌকাঠে, ৭ মার্চ— তাঁর সামনে স্বাধীনতাকামী বিপুলা জনসমুদ্র, একুশের প্রভাতফেরি- মওলানা ভাসানীকে নিয়ে চলেছেন, সাধারণ্যে অসাধারণ এক কিশোরীকে আশীর্বাদ করছেন রংপুর সার্কিট হাউসে, এক হিরকখচিত মুহূর্তে কবি নজরুলকে বরণ করছেন, রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল, বন্ধু কাস্ত্রোর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপরত। শাটল ডিপ্লোমেসির সমালোচিত রহস্যপুরুষ হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে ছবিটিও কথা বলছে। গ্রন্থের এমন অজস্র ছবি ইতিহাসের স্মারক ও বার্তাবাহক। 

বইটির সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক শামসাদ মর্তুজার কিছু অভিমত জানার সুযোগ হয় ১৭ মার্চ ইন্টারকন্টিনেন্টালের উইন্টার গার্ডেনে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিমফিয়ার মলাটে Sheikh Mujibur Rahman : The voice of the Vortex সেদিন আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৯৪৭ এ গান্ধীর ঘরোয়া সভার সেই বিখ্যাত ছবিটি দেখিয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, গান্ধীর নীতি তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না।” 

সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু বাংলাকে এক রাখার জন্যে প্রাণান্ত ছিলেন। গান্ধী মৌখিকভাবে তাতে সমর্থন জানালেও, ইংরেজের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ভারত ভাগের ভার কি বল্লভভাই প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরুর হাতে তুলে দেননি? সেক্ষেত্রে সত্যিকার সহায়তা কতটা করেছিলেন, তার বিচার আজ ইতিহাস করছে। সেই বৈঠকী সভার মুহূর্তগুলো ছিল খোকার শেখ মুজিব ওঠার প্রস্তুতিকাল।  সফল বিপ্লব তার বিপ্লবীদের হত্যা করে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির ফলে, নবীন দেশে বিবিধ বিদেশি ষড়যন্ত্রে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের পেট-পিঠ যখন এক হয়ে গেল, দলীয় অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়া কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষের চেষ্টা অবশেষে সফল হলো। শেখ মুজিবুর রহমানের এতকালের সমর্থকরা এসে দ্বিধাখণ্ডিত হয়ে যান। পরিণতি, বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে রক্তাক্ত জীবনাবসান। কথাগুলো গ্রন্থের স্মারক ছবিতে যতটা ব্যক্ত, ইংরেজি ধারাভাষ্যেও ততটা ব্যক্ত নয়।  

মিশন স্কুলের ফুটবল দলের ছবি দিয়ে যে Pictorial Autobiography’র শুরু, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে এম মনসুর আলীর সঙ্গে ধানমন্ডি হ্রদের ধারে তোলা শেষ ছবি দিয়ে তার অবসান। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণের তর্জনী তোলা বিখ্যাত ছবিটি। বইটির প্রচ্ছদশিল্পী ও শিল্পনির্দেশক আনিসুজ্জামান সোহেলের কাজকে উদ্দেশ করে শামসাদ মর্তুজা, বইয়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে গড়া নামমিতা-প্রচ্ছদটি ব্যাখ্যা করেন। “ছয়টি ঘূর্ণি দেখছি আমরা। যার কেন্দ্রে শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বয়ং কেন্দ্রীয় সপ্তম ঘূর্ণি। Vortex এর কেন্দ্রে উচ্চারিত হচ্ছে স্বাধীনতার ডাক। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ ছবিটা দেখুন। বইয়ে এই ছবির ওপর বড় একটি রক্তবিন্দু দিয়েছেন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল। বঙ্গবন্ধুর জীবনের এই সর্বশেষ ছবির ওপর রক্তবিন্দুটি তাঁর জীবেনের মর্মন্তুদ পরিসমাপ্তির স্মারক।” 

এই পর্যায়ে এসে, শুরুতে উল্লিখিত ১৯৪৯ সালে তোলা সেই ছবির কাছে ফিরি, সোহরাওয়ার্দীর চোখে ভয়াল বর্তমানের তটস্থতা ও শেখ মুজিবের চোখ স্বপ্নআঁকা। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সেইসব রাজনীতিকের একজন যাঁরা অতীত ও ভবিষ্যতের সম্বন্ধ ঘটাতেন। তাঁদের আদর্শিক রাজনীতির প্রবাহরেখা যোগ্য উত্তরসূরীর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পাড়ি দিত। যাঁরা মশাল বয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে করতেন, তাদের তিনি সযত্ন সান্নিধ্য দিতেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেই সান্নিধ্যধন্য তরুণ ছাত্রনেতাদের একজন। প্রত্যুৎপন্নমতি, দৃঢ়চেতা এই উদার ছেলেটির ভেতর সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। -প্রজ্ঞা ও সজ্ঞার প্রসাদ তাঁকে দু’হাতে দিয়েছেন তাঁরা। এরপরও, তারা কি এতদূর ভেবেছিলেন যে, একটি গৌরবময় স্বাধীন দেশের স্থপতি হিসেবে আসছে দিনের ইতিহাসে এই ছেলেটির নাম সোনার কলমে লেখা হবে? মানুষের জীবন তখন পদ্মপাতায় শিশির। সম্ভাবনারা ঝরে যাচ্ছে। এই একটি সম্ভাবনা বেঁচে গিয়েছিল যার প্রাণপ্রবাহ একদিন বাংলার বিপুলা জনসমুদ্রে ঢেউ তুলেছিল। বন্দি থেকেও তিনি প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার হৃদয়ে তিনি এমনভাবে ছিলেন, যেন আকাশ। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে, আন্দোলন থেকে সম্মুখ সমরে জয়ী হয়ে, স্বাধীন দেশটি যেন কারামুক্ত নেতাকে উপহার দিয়েছিলেন বাঙালি-আদিবাসী নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের গণমানুষ। সারা বিশ্বের ইতিহাসে সাধারণ মানুষের ওপর একচ্ছত্র ক্ষমতাবান এমন নেতা দেবদুর্লভ যাঁর ক্ষমতার উৎস ভালোবাসা। শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর ইতিহাসে সেই অপরাজেয় ব্যক্তিত্বের একজন। যেমন ব্যক্তিত্ব কেবল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে তৈরি হয় না। এর জন্যে প্রেম চাই।  কোনো জাতির সম্যক অস্তিত্বের সঙ্গে নাড়ির যোগ তৈরি হওয়া চাই। সেই যোগটুকু মানুষের জন্যে, জীবনের বড় সময়টা কারাগারে কাটানো শেখ মুজিবের মতো অশেষ ত্যাগের যোগ্যতায়, আর ক’জন অর্জন করেছেন? আলোকচিত্রের মতো সাক্ষ্য আর কী আছে? ইতিহাসের এই আলোকছবিগুলো ভাগ্যিস নানান গুণী শিল্পী ও সাংবাদিকের হাতে ধরা পড়েছিল। The voice of the Vortex এ সেসব একত্রিত হতে পেরে, গ্রন্থটিকে জাতিগত আকরগ্রন্থে পরিণত করে তুলেছে। তবে একটা আক্ষেপ বড় বাজছে। গ্রন্থটি একটি ছবিভিত্তিক আত্মজীবনী, অর্থাৎ ছবি এখানে মূল ভাষা। গ্রন্থজুড়ে, দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া, এই ছবির কারিগরদের নাম দেখতে পাওয়া যায় না। আশা করছি পরবর্তী সংস্করণে সংশ্লিষ্টরা এদিকে দৃষ্টি দেবেন। এ গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের স্মারক হিসেবে গ্রন্থিত, কবি কামাল চৌধুরীর মুখবন্ধে এর উল্লেখ পাওয় যায়। বইটির প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গ্রন্থটি আটটি অধ্যায়ে বিধৃত : A voice is born (1920-1947), Voice of the soil (1948-1954), Voice x Discontent (1955-1963), Voice of Resistance (1964-1969), Voice of Freedom (1970-1972), Voice of a Father (1972-1975), Voice of a Statesman (1972-1975), এবং সর্বশেষ Voice...Silenced and Beyond. শিরোনামগুলো ইতিহাসের গতি প্রকৃতির সন্ধান দেয়। 

আরও পড়ুন

×