মার্চের দিন: প্রতিশোধের ক্ষণ
স্বাধীনতা দিবস ২০২৪

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৩৫
১৯৭১ সালের মার্চ মাসটা কেমন ছিল?
প্রতিদিনের সূর্য ওঠার নিয়মে হয়তো একই রকম থাকবার কথা। তবে জলবায়ুর, পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ার ফলে আজকের মার্চের সাথে সেই মার্চের তুলনাই করা যাবে না। ফেব্রুয়ারি চলে
যাবার পরেও শীতটা যাই যাই করেও যাচ্ছিল না। একটা হাফছাড়া শেষটায় পড়তেই হতো। বাঙালির জাতীয় ঐক্য এমন একটা উচ্চ শৃঙ্গে গিয়ে পৌঁছেছিল যে একটা আত্মীয়তার বন্ধনে যেন আমরা সমগ্র জাতি আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের মধ্যে তখন কোনো শত্রুতা নেই। ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করে কোনো কিছুর দাম বাড়ায় না। রাষ্ট্রের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা তখন জনগণের হাতে। অঘোষিত একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, যার একমাত্র শত্রু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তার দোসররা। দোসরদের মধ্যে প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো, যে কিনা সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করে অন্যদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। অনেক জায়গায় জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল। মানুষ হত্যা করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই মানছে মানুষ, যার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। হাজার হাজার মানুষের গন্তব্য তখন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়ি। তিনিও একটা হ্যান্ডমাইক নিয়ে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু ছাত্ররা এগিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাক উড়িয়ে দিয়েছে। মৌলানা ভাসানী পল্টনে সভা করছিলেন, একই আওয়াজ সবার কণ্ঠে। মণি সিংহসহ প্রায় সকল রাজবন্দিই মুক্তি পেয়েছেন। বাম-ডান সবাই একদিকে। দৃশ্যতর পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসক নিষ্ক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকদের কথা আজ মনেই পড়ে না। কোথাও দেখা যায় না। ৭ই মার্চে রেসকোর্সে যে বিশাল সমাবেশ হলো সেখানে একজনও পুলিশ, ইপিআর অথবা সেনাবাহিনীকে দেখা যায়নি। বাসের ভাড়া বাড়েনি, রিকশাওয়ালারা আজকের মতো সুযোগ বুঝে ভাড়া বাড়ায়নি। সর্বত্র একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ৭ই মার্চে রেসকোর্সের সেই খোলা প্রান্তরে আমরা গিয়ে হাজির হলাম। উপরে একটা হেলিকপ্টার উড়ছিল। কিন্তু জনতা কোনো ভয় পায়নি। এর মধ্যেই নানা গুজব, নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে নেতা এসে হাজির। নাতিদীর্ঘ সেই ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা। শুধু স্বাধীনতা নয়, মুক্তির সংগ্রামের উচ্চারণ। হাজার হাজার মানুষ ওইখানে দাঁড়িয়ে। কারো ফিরে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। রেসকোর্স, ঢাকায় রাজপথ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর, গুলিস্তানের চারপাশ, তখনকার জিন্নাহ এভিন্যু, পল্টন ময়দান, মতিঝিল সবই যেন কথা বলছে। দিনের কোলাহল নেমে গেলেও সেই সময়কার স্বল্পালোকে সবাই যেন পরিচিতজন। এ সময় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের একজন ইপিআর প্রহরী আজকের ছাত্র মনে করে ডাকলেন। আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘ছাত্র ভাই, শেখ সাহেবরে একটা খবর পৌঁছাইয়া দেন, আমাগো বাঙালিগো অস্ত্র কিন্তু ক্লোজ করতাছে।’ এ খবর শেখ সাহেব আগেই জেনে গেছেন। তবুও তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্যে বলি ‘নিশ্চয়ই এ খবর পৌঁছে দেব’। সে সময় নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ, ছাত্রনেতা সবাই নাগালের মধ্যেই। এ সংবাদ পৌঁছানো কোনো কঠিন কাজই নয়। জনপ্রতিনিধিরা তখন মানুষের মধ্যেই থাকেন। তখন সারা পৃথিবীর বিপ্লবের কাহিনি পড়ি। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক কবি ভলতেয়ার আমাদের মুখে মুখে। প্যারি কমিউনের সেই দিনগুলোর কথা আমাদের প্রেরণা জোগায়। ভিয়েতনামে তখন যুদ্ধ চলছে। সেখানকার বিপ্লবীদের অমরগাথা আমাদের মুখে মুখে। সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত আমাদের চোখের সামনে। কৃষক সংগ্রামের অমর কাহিনিগুলি জীবন্ত হয়ে উঠছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের সেই বিপ্লবী গানগুলি সরব হয়ে উঠছে শিল্পীদের কণ্ঠে।
শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত একই সাংস্কৃতিক বিপ্লব যেন হয়ে গেছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই সকল ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা একত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার একটা নিয়ম চালু হয়েছিল। সেই ঐক্য প্রচেষ্টা থেকেই গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল। ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলের অফিসগুলি তখন ভরা শুধু নয় কর্মমুখর। এরপর শুরু হলো আলোচনা এবং বৈঠক। সেই সাথে লটবহর নিয়ে এলো ভুট্টো এবং পাকিস্তানের কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা। সামরিক জান্তাও সঙ্গে। থাকছেন আমাদের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ। প্রতিদিনের বৈঠক আমাদের কৌতূহল জন্ম দেয়, সেই সঙ্গে প্রসবিত হয় নানা গুজব, নানা সম্ভাবনার কথা। আপসহীন বাংলার নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের ফলাফলটাকেই মুখ্য করে ধরে আছে। এর মধ্যেই সামরিক জান্তা বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছে। তারা বেসামরিক জাহাজে করে অস্ত্র আনবার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাঙালি সৈনিক, বন্দরের দেশপ্রেমিক শ্রমিকরা তা বানচাল করে দিচ্ছে। ছোট-বড় নানা ধরনের সংঘাত চলছেই। এই সময়ে তখনকার ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র যেন স্বাধীনতার মন্ত্রে জ্বলে উঠেছে। ঘরে ঘরে তখন একই আলোচনা, স্বাধীনতার প্রশ্নটা তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো যেন তরুণ যোদ্ধাদের একেকটা যুদ্ধ শিবির। ছোটখাটো পত্রিকা বের হচ্ছে, সেগুলোতেই স্বাধীনতার আহ্বান। মুসলিম লীগ বা জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ তাদের কর্মীবাহিনী নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। তাদের একাংশ আবার মিলে যেতে চাইছে মূলধারার সঙ্গে। এমনি করেই আশা-নিরাশা নিয়ে দিনগুলি কাটছিল। একদিকে নেতৃবৃন্দ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুমুন্নত রাখতে চাইছেন, আবার কেউ কেউ এই বৈঠককে নিরর্থক ভাবছেন। পাকিস্তানিদের শাসনের প্রতি জনগণের অবস্থা একেবারেই নিঃশেষিত। চব্বিশ বছরের শোষণের ফলে যে সোনার বাংলা শ্মশান হয়ে গেছে, তাতে আর কারো সন্দেহ নেই। পূর্ব পাকিস্তানে যে কলকারখানা গড়ে উঠেছে তার মালিকানা পাকিস্তানের তৈরি বাইশ পরিবারের হাতেই। পাটশিল্প তখন বিশ্বের সোনালি সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে, কিন্তু তাতে এই অঞ্চলের মানুষের কোনো অধিকার নেই। এ দেশের অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানে বড় বড় প্রকল্প গড়ে উঠেছে, একের পর এক রাজধানী স্থানান্তর হচ্ছে। করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডি তারপর ইসলামাবাদ। সেনাবাহিনী, প্রশাসনে এই অঞ্চলের সংখ্যালঘিষ্ঠতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যোগ্য লোকরা কোথাও কোনো কর্তৃত্বে থাকতে পারছে না। চীন বিপ্লব তখন আমাদের প্রেরণার উৎস। মাও সেতুং, চু-এন-লাই, মার্শাল চুতে তখন জীবিত। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এত বড় অবিচারে তারা নিশ্চুপ। আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছে, সহযোগিতা করছে তাতে আমাদের ক্ষোভ হচ্ছিল, কিন্তু চীনের ভূমিকায় আমরা হতবাক। চীনা অস্ত্র যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক শক্তির উৎস, তখন আমাদের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। এ সময় অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুল করেনি। তারা যথাসময়েই প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। এর মধ্যে মার্চের পাতা ঝরার দিন ঘনিয়ে আসছে। একটি দুটি থেকে হাজার হাজার লক্ষ পাতা ঝরছে। অবশেষে এলো মার্চের প্রায় শেষ। বৈঠক ব্যর্থ হতে চলেছে। ভুট্টো তার দলবল নিয়ে উঠে গেল বিমানে। সামরিক জান্তাপ্রধানও তাই একই কাজ করল। কিন্তু বাঙালি জাতি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। শহরের বেশ কিছু জায়গায় গড়ে উঠেছে ব্যারিকেড। সবচেয়ে বড় ব্যারিকেড ক্যান্টনমেন্টের মুখ থেকে ফার্মগেইট। এ সরাসরি একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি। ওই রাতে আমরা ছিলাম পরিচালক-চিত্রগ্রাহক সামাদ ভাইয়ের গ্রীন রোডের বাড়িতে। তখন পান্থপথ হয়নি। গ্রীন রোডের রাস্তাও এত প্রশস্ত ছিল না। একেবারে রাস্তার উপরেই বাড়ি। রাত একটু গভীর হতেই কামানের শব্দে শহর কেঁপে উঠল। বুঝতে পারলাম, ব্যারিকেড ভাঙা হচ্ছে। ট্যাঙ্ক নামল আকাশে হাউই বাতির আলোর ঝলকানি। নিচে ট্যাঙ্ক, কামান, সাঁজোয়া গাড়ির কনভয়। তিনটে পথ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করল। ধানমন্ডির পথ দিয়ে পিলখানা। দ্বিতীয় পথ গ্রিন রোড হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং তৃতীয় পথ ফার্মগেট হয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। বিশ্বাসঘাতক সামরিক জান্তা ও ভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতা ভুট্টো পাকিস্তানের একাংশ বলে কথিত নিজের দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিষ্ঠুরতম সেনাবাহিনীর হাতে দিয়ে পালিয়ে গেল। দু’জনেই অবশ্য নিজেদের কাজকর্মের পুরস্কার পেয়েছে। প্রথমজন ইতিহাসের এক জানোয়ারের জায়গায় আর একজন স্বদেশেরই তার প্রিয় সামরিক জান্তার বিচারে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেছে। গ্রিনরোড দিয়ে যাচ্ছে সাঁজোয়া গাড়ি। মারাত্মক একটা ঝুঁকিতে আমাদের এই বাড়িটা। পেছন থেকে বেরোবার কোনো পথ নেই। কোনো বিকল্প কামানের বিপরীতে প্রতিরোধের শব্দও পাওয়া গেল।
বারবার মনে পড়ছে সেই ইপিআর সদস্যের কথা। সেই তরুণ কি এখন প্রতিরোধ যুদ্ধে লোক আক্রমণের প্রথম প্রহরেই প্রাণ হারাল। পথঘাট বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, রাজারবাগ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বাজারহাট সবই আক্রান্ত। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সারারাত শুধু গলা ভেজাবার জন্যে একটু পানিই আমাদের খাদ্য। ভেবেছিলাম আজানের সময় একটু বোধহয় বিরতি হবে। আজানের ওপর দিয়েই গুলি চালিয়ে দিল ইসলামের রক্ষক পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পরদিন সারাদিন গুলি, অগ্নিসংযোগ, সঙ্গী তাদের রাস্তার কুকুর। কুকুরগুলো মানুষের এই অসহায়ত্বে কাঁদছে সমবেদনায়। জাতি তখন শেখ মুজিবের জন্যে উৎকণ্ঠিত। ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুরতম কণ্ঠ শোনা গেল। সব দোষ যেন বাঙালিদের। মনে আছে সেই কণ্ঠের উচ্চারণ This Man Cannot go unpunished. বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। কোথায় নিয়ে গেল, জানার উপায় নেই। ততক্ষণে হৃদয়ের আগ্নেয়াস্ত্রটি উত্তপ্ত হয়ে গেছে। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম– এর প্রতিশোধ নিতেই হবে। নির্মম প্রতিশোধ।
লেখক
নাট্যব্যক্তিত্ব
- বিষয় :
- স্বাধীনতা দিবস