মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের এক দশক
স্বাধীনতা দিবস ২০২৪

শাহরিয়ার কবির
শাহরিয়ার কবির
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৩২
গত তিরিশ বছর ধরে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১– বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা বলতে গেলে তাঁর জীবনীগ্রন্থগুলোয় সেভাবে আসেনি। অথচ বাংলাদেশকে একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু এই দশকেই সম্পন্ন করেছিলেন।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে সমার্থক মনে করি। এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা যেভাবে দেখি; যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, যারা বাংলাদেশ চায়নি তারা অন্যভাবে দেখে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে তাদের যে বয়ান আমরা লক্ষ্য করি তা হলো– বঙ্গবন্ধু একটা জাতিকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় রেখে পাকিস্তানিদের নিরাপদ হেফাজতে চলে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি বা দিকনির্দেশনা বঙ্গবন্ধুর ছিল না। সে সময় জনৈক মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, গোটা জাতি সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল! এ যেন এক ভানুমতির জাদুর খেলা! বিএনপি-জামায়াতিদের এই বয়ান নির্জলা মিথ্যা তো বটেই এবং একই সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রসূত– সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পৃথিবীর যেসব জাতি সশস্ত্র যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া এমন একটি নজির পাওয়া যাবে না যে, নয় মাসের যুদ্ধে স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার যদি পূর্বপ্রস্তুতি না থাকত, বঙ্গবন্ধু যদি জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত না করতেন তাহলে নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ কখনও স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমরা পড়েছি– চল্লিশের দশকের শুরুতে ছাত্রজীবনে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় মাসের মধ্যে, ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মোহভঙ্গ ঘটেছিল। পাশাপাশি আমরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথাও বলতে পারি, যিনি ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আইন পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি জানিয়ে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বাঙালির প্রস্তুত হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ২৩ বছর। ’৪৮-এর যে ভাষা আন্দোলন, সেখান থেকে ’৫২, ’৫২ থেকে ’৬১, ’৬৬, ’৬৯ এবং সবশেষে ’৭১ পর্যন্ত অনেক সময় লেগেছিল বাঙালিকে তৈরি করতে– যে বাঙালি মুসলমানের ভোটে পাকিস্তান হয়েছিল। বাংলাদেশে প্রথমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, এরপর গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার দাবি এবং মুক্তিযুদ্ধ, একটা সফল সশস্ত্র যুদ্ধ– এটা কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া হতে পারে না।
আমরা আগরতলা ‘ষড়যন্ত্র’ মামলার কথা জানি। যদিও তখন বলা হয়েছিল এটা একটা ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধু নিজেও তখন বলেছেন ‘তথাকথিত (এই) ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’ আদালতে তাঁকে বলতে হয়েছিল, এর সঙ্গে তিনি বিন্দুমাত্র যুক্ত নন এবং এটাই স্বাভাবিক। কেননা মামলাটা হচ্ছে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। মামলার যারা আসামি সেখানে বলা হয়েছে– রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছে– তিনি এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে কখনও যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে যারা যুক্ত ছিলেন তারা অনেকেই তাদের স্মৃতিকথা লিখেছেন, সর্বশেষ শওকত আলীর যে বই– ‘আগরতলার সত্য ঘটনা’ সেখানেও তিনি সত্য ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৪ সাল থেকে কখন কোথায় কীভাবে এই মামলার অভিযুক্তদের সঙ্গে সশস্ত্র বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন মামলার অভিযুক্তরা পরে সবই বলেছেন। কিন্তু এগুলো হচ্ছে খণ্ডিত বিষয়। আগরতলা মামলা ও প্রাসঙ্গিক বিষয় বঙ্গবন্ধুর এক দশকের কার্যক্রমের একটি অংশ মাত্র।
আমরা নিউক্লিয়াসের কথাও শুনেছি। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য আবদুর রাজ্জাক আমাকে বলেছেন, ছাত্রলীগের তিনজন তরুণ নেতা ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি একটি ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেছিলেন, প্রথমে নাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’, পরে এর নামকরণ হয়েছে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘বিএলএফ’। এই নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ। এই নিউক্লিয়াস নিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক হয়েছে। আমরা দীর্ঘকাল অপেক্ষা করছিলাম, রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খান, যিনি নিউক্লিয়াসের অন্যতম নেতা তিনি কি বলেন। আমি এ বিষয়ে আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলেছি, কাজী আরেফ আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছি, আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের স্মৃতি, রেকর্ড এবং বক্তব্য থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বটা কিছুটা বুঝতে পারি– ’৬১ থেকে ’৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য গোপন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু কীভাবে নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ’৯৬ থেকে ’৯৭-এর দিকে দৈনিক জনকণ্ঠে আমার ধারণকৃত সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ বেরিয়েছিল এবং সে সময় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা বলেছিলেন, আপনি এগুলো এখন লিখবেন না। এটা বলার কারণ হচ্ছে, পাকিস্তানিরা সবসময় প্রচার করেছে শেখ মুজিব পাকিস্তানের শত্রু ছিলেন। ভারত পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য ’৪৭ সাল থেকে ষড়যন্ত্র করছিল। বাংলাদেশ সেই ষড়যন্ত্রেরই পরিণতি এবং শেখ মুজিব ভারতের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের অনেকে মনে করেন, এসব কথা বললে বঙ্গবন্ধু ভারতের দালাল হয়ে যাবেন!
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ বয়ান লেখার সময় হয়েছে। আমরা এ কথা এখন নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’-এর অবদানও স্বীকার করতে হবে ইতিহাসের প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সরকার এগুলোকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি। এখানে কতগুলো দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। অনেকেই মনে করেন যে এই কথাগুলো বললে পাকিস্তানের যে বয়ান সেগুলোই সত্যি হয়ে যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছেন পাকিস্তান ভাঙার জন্য! আমার প্রশ্ন, পাকিস্তান ভাঙা কেন আমাদের জন্য অপরাধ হবে? পাকিস্তান না ভাঙলে বাংলাদেশ কীভাবে স্বাধীন হতো? এই যে ইতিহাসকে দু’ভাবে দেখা– সত্য এবং মিথ্যার ভেতর পার্থক্য কীভাবে টানব? গণহত্যার বিষয়টাও যখন আলোচনা করি তখন দেখা গেছে, গণহত্যাকারীরা একভাবে তাদের ইতিহাস বলছে, ভিকটিমরা আরেকভাবে বলছে। দুটোকে কখনও মেলানো যাবে না। আমরা অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস যখন আলোচনা করব স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাকামী বাঙালি যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন– সেই প্রেক্ষাপট থেকেই আমাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করব। এখানে নিরপেক্ষ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেখার বিষয় হচ্ছে– আমাদের ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ কিনা, তথ্যের কোনো বিকৃতি হচ্ছে কিনা। স্বাধীনতার গোপন সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে যতটুকু লিখেছি এর সিংহভাগ হচ্ছে আমার গবেষণা। যার বেশির ভাগ লিখিত নেই, সম্পূর্ণ ওরাল হিস্ট্রি। আমি লিখিত তথ্য পেয়েছি প্রক্ষিপ্ত কিছু স্মৃতিকথা থেকে। কয়েক বছর আগে আমার এবং আরও কয়েকজনের বিভিন্ন লেখার ভিত্তিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’। এ বিষয়ে মামুনের গ্রন্থটি অসম্পূর্ণ হলেও, নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত হবে। সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ আছে। কিছু সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ কিছু বই লিখেছেন। সেখানে এই প্রস্তুতিপর্বের কিছু কথা আছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে যারা লিখেছেন তাদের লেখার ভেতর কিছু কথা আছে। সম্প্রতি সিরাজুল আলম খানের যে দুটো বই বেরিয়েছে– একটি তাঁর সাক্ষাৎকার, আরেকটি তাঁর নিজের লেখা সেখানেও কিছু আছে, কিন্তু সেখানে সত্যের বিকৃতি ঘটেছে। সিরাজুল আলম খান লিখেছেন, তারা যখন ’৬২ সালে নিউক্লিয়াস করলেন তখন সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বিন্দুমাত্র জানতেন না। এ বিষয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছেন ১৯৬৯ সালে। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা বঙ্গবন্ধুকে না জানিয়ে এমন দুঃসাহসী কাজ করবেন, বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে কিছু জানতেন না– এটা কখনও হতে পারে না। আব্দুর রাজ্জাক আমাকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন নিয়েই তারা ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের ভেতরে নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন। তারা ধীরে ধীরে খুব গোপনে প্রস্তুতিটা গ্রহণ করেছেন। একদিকে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের একটা প্রস্তুতি, এরপর আগরতলা মামলায় উল্লিখিত ঘটনাবলি। পাকিস্তানি প্রশাসনের ভেতরে আমাদের কিছু বাঙালি অফিসার ছিলেন, সামরিক বাহিনীর কিছু ব্যক্তি ছিলেন– যাদের আগরতলা মামলায় আসামি করা হয়েছে। বাইরেও কিছু ব্যক্তি ছিলেন। কেউ কেউ রাজসাক্ষীও হয়েছিলেন। তারাও বলেছেন, কখন কোন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু কীভাবে তাদের উৎসাহিত করেছেন।
যখন রাজ্জাক ভাই আমাকে বলেছিলেন, কীভাবে বঙ্গবন্ধু গোপনে প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং কী কী করেছেন, তখন ইতিহাসের খাতিরে, সত্যের খাতিরে আমাকে প্রশ্ন করতে হয়েছে– এ প্রশ্ন যে কেউ করতে পারে, আপনি যেটা দাবি করছেন, সেটা আপনার নেতাকে মহানায়ক বানাবার জন্য বলতে পারেন– তিনি ’৬১ সাল থেকে এটা করেছেন। আপনার কথার বাইরে এসব তথ্যের প্রমাণ কোথায় পাওয়া যাবে? তিনি আমাকে কতগুলো নাম দিয়েছেন। বলছেন আপনি এদের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের কেউ ভারতীয় প্রশাসনে ছিলেন, কেউ আগে আওয়ামী লীগ করতেন। এদের ভেতর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজনের নাম চিত্তরঞ্জন সুতার। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার দু’বছর পর আমি যখন কলকাতায় কাজী আরেফ আহমেদের চিঠি নিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে দেখা করলাম– তিনিও তখন একই কথা বললেন। তাঁকেও আমি বলেছি, আপনি যেটা বলছেন– তার সত্যতা আমি কোথায় পাব? তিনি একটা কথা বলেছেন সেটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য– ‘দেখুন, কাজটা তো হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙার একটা উদ্যোগ, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে হবে। পাকিস্তানিরা যেটাকে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙার ষড়যন্ত্র বলছে, সেটা তো কখনও প্রকাশ্যে হতে পারে না। কোনো চুক্তির মাধ্যমে এসব হয় না। কাজটা ছিল খুব গোপনীয়। আপনি যদি প্রমাণ চান আপনাকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার নথিপত্র দেখতে হবে।’ আমাকে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে যা বলব, আমার জীবদ্দশায় তা প্রকাশ করতে পারবেন না।’ মুক্তিযুদ্ধে চিত্ত সুতারের অবদান বাংলাদেশের মানুষ না জানলেও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা জানত। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়ার সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করে দিয়েছিল।
চিত্তরঞ্জন সুতার মারা গেছেন ২০০২ সালে। আমিও এখন জীবনের সায়াহ্নে উপস্থিত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাঁর দূরদর্শিতা, তাঁর সাহস কোন স্তরের ছিল, তা ইতিহাসের প্রয়োজনে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। একই সঙ্গে জানাতে হবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে কারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় সাহসী সহযোগী। যে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলন করেছে, যাদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে– সেই বাঙালি মুসলমান কীভাবে ২৪ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এত বড় একটা যুদ্ধ করল? ত্রিশ লাখ মানুষ জীবন দিল? এটা অসাধারণ একটা ঘটনা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই অসাধ্য সাধনের মহানায়ক। ১৯৬২ সালে যখন বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াস গঠন করেছেন, তার প্রথম চিন্তাটি ছিল– বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য তরুণদের প্রস্তুত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গেরিলা যুদ্ধ করতে হলে প্রতিবেশী কোনো একটা দেশের সহযোগিতা লাগবে। যেটাকে আমরা যুদ্ধের ভাষায় পশ্চাদভূমি বলি। কোথায় গিয়ে আমাদের গেরিলারা আশ্রয় নেবে বা কোথায় প্রশিক্ষণ নেবে বা অস্ত্র কোথায় পাবে? আমরা তিন দিক দিয়ে ভারত দ্বারা বেষ্টিত এবং এ ক্ষেত্রে ভারতের কাছে যাওয়াটাই হচ্ছে স্বাভাবিক। ’৬২ সালের জানুয়ারিতে আগরতলা মিশন ব্যর্থ হলেও বঙ্গবন্ধু হাল ছেড়ে দেননি। গোয়েন্দা সূত্র বাদ দিয়ে সে কারণেই পাকিস্তানে ঢাকায় ভারতীয় যে উপ-দূতাবাস ছিল– তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে যোগাযোগ করতে হয়েছিল।
সরকার গঠন থেকে শুরু করে সশস্ত্র যুদ্ধের যাবতীয় প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার অনেক আগেই নিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা কী বলবে, বা কী ভাববে এসব বিবেচনা থেকে আমরা যদি বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীদের তাদের প্রাপ্য কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করি, পূর্বপ্রস্তুতির বিষয়টি গোপন করে মুক্তিযুদ্ধকে যদি ’৭১-এর নয় মাসের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যে উদ্দেশ্যে সংবিধানের মুখবন্ধ থেকে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধকে নয় মাসের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলেছিলেন– সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে ধাপে ধাপে প্রকাশ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের পাশাপাশি কঠোর গোপনীয়তার ভেতর বাংলাদেশকে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং গোটা জাতিকে স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করেছিলেন– সে ইতিহাস যথাযথ লিপিবদ্ধ হলে একজন দক্ষ, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতা হিসেবে ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হবেন।
লেখক
সাহিত্যিক
গবেষক
- বিষয় :
- স্বাধীনতা দিবস