মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ
স্বাধীনতা দিবস ২০২৪

আবু সাঈদ খান
আবু সাঈদ খান
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৩৩ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ | ১৩:২৮
বিংশ শতাব্দীতে উপমহাদেশের রাজনীতিতে দুটি বড় ঘটনা; ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ব্রিটিশ শাসনের শেষলগ্নে হিন্দু-মুসলমান বিরোধে লিপ্ত হয়, ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়। এ ঘটনার ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ।
দুটি সংগ্রামের ধরন-ধারণেও পার্থক্য দৃশ্যমান। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে; যার অনন্য প্রকাশ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ। এরপর নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড দুই-ই চলেছিল। তবে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা পেয়েছে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে, আলোচনার টেবিলে। অপরদিকে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়; তা ছিল নিরস্ত্র, নিয়মতান্ত্রিক। এর ২৩ বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রেক্ষিত সম্পর্কে সবাই অবহিত। নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা এবং ২৫ মার্চ নিরস্ত্র জনগণের ওপর হামলার জবাবে সৈনিকরা রুখে দাঁড়ায়, ছাত্র-যুবকরা অস্ত্র তুলে নেয়। শুরু হয় হয় মুক্তিযুদ্ধ। এ পথে আসে স্বাধীনতা। ইতিহাসের এ বয়ান নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বিমত নেই। কিন্তু এর আগেও যে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়াস ছিল, বৈপ্লবিক তৎপরতা ছিল– সেই গৌরবগাথা ইতিহাসে আজও উপেক্ষিত, অনালোকিত।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে রাজনীতির ওপর খড়্গ নেমে আসে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান প্রমুখকে নির্বাচনে অযোগ্য (এবডো) ঘোষণা করা হয়। প্রবীণ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যান।
পাকিস্তানে গণতন্ত্র চর্চার যে ন্যূনতম সুযোগ ছিল, সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে তা তিরোহিত হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে চরম হতাশা। তখন যুব মানসে বিপ্লবের স্বপ্ন দোলা দেয়। পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার লক্ষ্যে বেশ ক’টি গোপন সংগঠন গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল আজিজ বাগমারের নেতৃত্বে অপূর্ব সংসদ, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস, লন্ডন প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির আনহ্যাপি ইস্ট পাকিস্তান উল্লেখযোগ্য। আনহ্যাপি ইস্ট পাকিস্তান লন্ডনে সভা-সেমিনারের আয়োজন করে। দেশের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস ছাড়া অন্য সংগঠনগুলোর কার্যক্রম ছিল গোপন বৈঠক, প্রচারপত্র বিলি ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিউক্লিয়াস ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার সপক্ষে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৬৬ সালে তারা শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সেনা সদস্যদের মধ্যেও অঙ্কুরিত হয়। ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে তৎপরতা চলেছিল; সংগত কারণেই তা ছিল গোপন। পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে; যেটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বলে পরিচিত। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ সামরিক অফিসার-সৈনিক এবং তিন সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্দুস, আহমেদ ফজলুর রহমান ও খান শামসুর রহমান। ১৯৬৮ সালের ২১ জুন ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। মামলার বিবরণীতে তাদের বিরুদ্ধে ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের জন্য নানা তৎপরতার কথা বলা হয়। ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে আগরতলায় গোপন বৈঠকের উল্লেখ করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ, বৈঠক ও সহায়তা প্রদানের কথাও উল্লেখ করা হয়। প্রথম দিকে বিষয়টি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বলেই জনমনে ধারণা তৈরি হয়। ক্রমে জনগণ স্বাধীনতার উদ্যোগের বিষয়টি বিশ্বাস করতে শুরু করে। কেউ কেউ এ নিয়ে গর্বিত হয়।
সে সময় দৈনিক আজাদে আগরতলা মামলার ওপর রিপোর্ট করেছিলেন সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “মামলাবিরোধী পত্রিকাগুলোর সাংবাদিকরা এই মামলাকে মিথ্যা মামলা হিসেবে অভিহিত করে এলেও প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীর কতিপয় অফিসার-কর্মীসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অফিসারদের পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার এই প্রাথমিক সশস্ত্র আয়োজন সত্য ও বাস্তব ছিল। দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে দেশপ্রেমিকদের উদ্ধারের জন্য মামলাটি মিথ্যা বলে অভিহিত করে মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই ‘মিথ্যা’ স্বাধীনতা আন্দোলনের কলাকৌশলের বলে অভিহিত করা বাঞ্ছনীয়।” (ফয়েজ আহমদ, আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ, পৃ. ১৯)
মামলার অন্যতম আসামি কর্নেল শওকত আলীর বইয়ের নাম ‘সত্য মামলা আগরতলা’। স্বাধীনতার পর অভিযুক্তদের আরও কয়েকজন স্মৃতিচারণমূলক বই লিখেছেন। অন্যরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সেই বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। এ ঘটনার মূল নায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন মুখ খোলার সুযোগ পাননি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসভবনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আত্মজীবনীর পরবর্তী অধ্যায়গুলো লেখার সুযোগ পেলে অনেক অজানা তথ্য জানা যেত। তবে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সাহিত্যিক অন্নদা শঙ্কর রায়কে বলেছিলেন, ‘আমার কী প্ল্যান ছিল জানেন? অকস্মাৎ আমরা একদিন পাওয়ার সিজ করব। আর্মিতে, নেভিতে, এয়ারফোর্সে, সিভিল সার্ভিসে, পুলিশে আমাদের লোক ছিল। তবে একটা লোকের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সব পণ্ড হয়ে যায়। নেভির একজন অফিসার বিশ্বাস করে তাঁর অধীনস্থ একজনকে জানিয়েছিলেন। সে ফাঁস করে দেয়। তখন আমরা সবাই ধরা পড়ে যাই।’ তিনি আক্ষেপ করেন। (অন্নদা শঙ্কর রায়, ইন্দ্রপাত; আমার ভালোবাসার দেশ, পৃ. ১৬)।
সেনাছাউনিতে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি এক অনন্য ঘটনা। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে নৌবাহিনীর অভ্যন্তরে সূচিত বিপ্লবী সংগঠন সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে বিস্তৃত হয়। তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতা নির্বাচিত করে চূড়ান্ত লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তখন আমির হোসেন-মোজাম্মেল-মীর্জা রমিজসহ কতিপয় ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতায় সব ফাঁস হয়ে যায়। ফলে বিপ্লবীরা চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারলেন না সত্য, তবে আগরতলা মামলা রাজনীতির বাঁকবদল করেছিল, জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
যখন স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান, তখন রাজপথে স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছিল– পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। এভাবেই সৈনিক ছাত্র-জনতার সংগ্রাম একরেখায় মিলিত হয়। এসব স্লোগানের মূলে ছিল নিউক্লিয়াস প্রভাবিত ছাত্রলীগের র্যাডিক্যাল ধারার কর্মীরা; স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীনতার সিংহদ্বারে পৌঁছাতে তারাই অগ্রণী। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই স্বপ্নবাজ তরুণদেরও সর্বাধিনায়ক। তবে ছাত্রলীগের এ র্যাডিক্যাল ধারার কর্মীদের সঙ্গে যে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার অমিল হয়নি, তা বলা যাবে না। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘অতি বিপ্লবী কয়েকটি স্লোগান বা রাতের অন্ধকারে আকস্মিকভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়া বিপ্লব হয় না। বিপ্লবের উদ্ভব ঘটে দেশের মাটি হইতে এবং বিপ্লবের নির্ধারিত কালও আছে… ৬ দফা ব্যর্থ হইলে কয় দফা দিতে হইবে তাহা আমার জানা আছে।’ (৫ জানুয়ারি, ১৯৭০; দৈনিক ইত্তেফাক)। তা সত্ত্বেও তাদের কাঁধে ছিল বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদের হাত। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা শেখ মুজিব জনগণ-নন্দিত মহানায়ক, বঙ্গবন্ধু খেতাবে অভিষিক্ত। ১৯৭০ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নির্বাচন বয়কট করলেও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ মানে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়া নয়; মূল লক্ষ্য ছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গণরায় লাভ। নির্বাচন-উত্তর এ গণরায়কে অবলম্বন করে শুরু হয় আন্দোলনের নতুন অধ্যায়। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সংসদ অধিবেশনের কথা ছিল, ১ মার্চ তা স্থগিত করা হলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তখন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা, বেতার-টেলিভিশন, সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিকল্প প্রশাসন চালু হয়। অসহযোগ আন্দোলন উপমহাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন এক ছিল না। গান্ধীর অসহযোগ ছিল সরকারের সঙ্গে কেবল অসহযোগিতা; অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রশ্নে তিনি ছিলেন স্পর্শকাতর। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র প্রস্তুতির বিরোধিতা করেননি, বরং উৎসাহিত করছেন।
অসহযোগ আন্দোলনকালে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি বিকল্প প্রশাসনিক দপ্তরে পরিণত হয়, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল (ইকবাল হল) হয়েছিল সশস্ত্র প্রস্তুতির কেন্দ্রবিন্দু। ওখান থেকে জেলায় জেলায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হতো। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আগরতলা মামলার অভিযুক্ত বা বেসামরিক পোশাকে আসা সৈনিক-অফিসারদের মধ্যে চলত শলাপরামর্শ। ইতিহাসবিদরা এ অধ্যায় সম্পর্কে নির্বিকার হলেও কেউ কি অস্বীকার করতে পারেন যে এই তরুণ তুর্কিরাই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছেন? তারাই ৩ মার্চ পল্টনে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেছেন, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেছেন। ওই দিন পল্টনে স্লোগান দেওয়া হয়– স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, দীর্ঘজীবী হোক; স্বাধীন বাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব; বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর; গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর ইত্যাদি। ছাত্রলীগের এই কর্মীরাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে যাত্রাকালে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রতিরোধ দিবস পালন করেছে। প্রেসিডেন্ট হাউস আর ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সেদিন অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, হাটবাজার, বিদেশি দূতাবাসসহ সর্বত্রই স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাধীনতাপন্থি ও স্বায়ত্তশাসনপন্থিদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ছিল, ১ মার্চের পর আন্দোলনের উত্তাপে সেই দ্বন্দ্ব উবে যায়, সবাই স্বাধীনতার প্রশ্নে একাট্টা হয়। পিছিয়ে ছিল না অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তি। স্বাধীনতার প্রশ্নে মওলানা ভাসানী শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। পিকিংপন্থি ছাত্র সংগঠন ‘জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমে সংগঠিত হয়। মস্কোপন্থি ছাত্র ইউনিয়নও স্বাধীনতার প্রশ্নে সক্রিয় হয়। তবে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক আর আন্দোলনের শক্তি নিউক্লিয়াস প্রভাবিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
এ উত্তাল সময়ে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে বিভিন্ন স্থানে সভাসমাবেশ করে। সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যার পরও তাঁর সঙ্গীরা পথ হারাননি। আগরতলা মামলার সব অভিযুক্তই নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সৈনিক-বিপ্লবীরা যে জাগরণ এনেছিলেন, তা ছিল বাঙালি সৈনিক-অফিসারদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুপ্রেরণা।
একাত্তরে শিক্ষাঙ্গনের র্যাডিক্যাল ধারা ও সেনাছাউনির বিপ্লবী ধারা একরেখায় মিলেছে। এই সম্মিলিত শক্তিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি।
লেখক
মুক্তিযোদ্ধা
সাংবাদিক
ও লেখক
- বিষয় :
- স্বাধীনতা দিবস