স্বাধীনতা দিবস ২০২৪
স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের তাৎপর্য
১৯৭১ সংগ্রাম থেকে সমর

ইনাম আহমদ চৌধুরী
ইনাম আহমদ চৌধুরী
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ২৩:৩৮
আমাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের বিশেষ ও বিরাট তাৎপর্য রয়েছে। ২৫শে মার্চ পাকিস্তান আর্মির বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের শুরুতেই নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বাণী সংগ্রামী বাঙালির কাছে পৌঁছে যায়। বস্তুতপক্ষে তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণই হলো স্বাধীনতার মহাকাব্যিক ঘোষণা। নির্দেশিত অসহযোগ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ভিত্তিপ্রস্তর মজবুতভাবেই স্থাপিত হয়ে গেল। ২৬শে মার্চ হলো বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র স্থাপনা এবং তুমুল রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তব সূচনা।
বস্তুতপক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রাজ্ঞ দূরদর্শিতায় Unilateral declaration of Independance-ইউডিআই দেননি। কয়েক বছর আগেই নাইজেরিয়ায় বায়াফ্রার ইউডিআই ঘোষণা ফলপ্রসূ ছিল না। দীর্ঘকাল কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল স্যার শ্রীধাত রামফাল থাকার পরে তাঁর ডেপুটি, নাইজেরিয়ার প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিফ এমিকো আনিয়াকু (যিনি আদিতে বায়াফ্রান ছিলেন) কমনওয়েলথের মহাসচিব হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি লন্ডনের মার্লবোরো হাউসে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনাকালে বলেছিলেন– বাংলাদেশের শেখ মুজিব অত্যন্ত বিজ্ঞজনের মতো অতুলনীয় বিচক্ষণতায় বহু প্ররোচনা সত্ত্বেও ইউডিআই দেননি। এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করলে কমনওয়েলথকে একটি সদস্য রাষ্ট্র (পাকিস্তান) এর বিভক্তিকরণের বিরোধিতা করতে হতো। যেমনটি বায়াফ্রার ক্ষেত্রে করা হয়েছিল। “কিন্তু যেহেতু কোনো ইউডিআই ছিল না, আমরা যৌক্তিক ও মানবিক কারণে বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তিকে স্বাগত জানিয়েছি।” বরং পাকিস্তানই কমনওয়েলথ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরে অবশ্য পুনর্বার যোগদান করে।
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশ তো কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি নয়। কেউ কেউ বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে পাকিস্তান আর্মির আকস্মিক বর্বরোচিত আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভাবতে পারেন। কিন্তু আসলে তো জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাঙালিদের আবাসভূমি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা একটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল। দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশ শুধু এক বা দুই জাতির নয়, অন্য জাতিও রয়েছে– যারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যুক্তিসংগতভাবেই দাবি করে। উপমহাদেশের এই পূর্বাঞ্চল চিরকালই দিল্লি বা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীন হতে চেয়েছে। ২৫শে মার্চের পাকিস্তানের দুঃসহ আক্রমণ সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। জাতি হিসেবে শত শত বৎসর পূর্বে গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের এই অঞ্চল। সম্ভবত ‘বঙ্গাল’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে পাঠান শাসনকালে। গঙ্গাঋদ্ধি, সমতট, সোনারগাঁ, বঙ্গ, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ় ইত্যাদি নামে এই এলাকার কোনো কোনো অংশের নামকরণ ছিল। চারশতাধিক বৎসর পূর্বে পাঠান শাসক ইসলাম খান ঢাকাকে এতদঞ্চলের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। পাঠান-মোগল আমলে এলাকাটি ‘সুবেহ্-বাংলা’ বলে পরিচিতি লাভ করল। ব্রিটিশ আমলে হলো ‘বেঙ্গল’, সাধারণ্যে ‘বাংলা’ বা ‘বাংলাদেশ’। আর জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নাম দিয়ে একে প্রতিষ্ঠা করলেন এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান– সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম ছিল একটি জাতির অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার ও স্বীকৃতি অর্জনের সংগ্রাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখি দেশটা স্বভাবগতভাবে কখনও ভারতবর্ষ বা ইন্ডিয়ার অংশ ছিল না। বাংলাতে দিল্লির শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সব সময় যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং বিজেতার শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। মোগল এবং ব্রিটিশ আমলে আমরা তা-ই প্রত্যক্ষ করি। দিল্লিতে পাঠান শাসনকালে আমরা বাংলাতে স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দেখি– হোসেন নসরৎ শাহ বাংলা ভাষাকেও স্বীকৃতি দিলেন ও পৃষ্ঠপোষকতা করলেন। অবশ্য ‘পাল’ এবং ‘সেন’ বংশীয় রাজারা স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন এবং তারাও দিল্লি বা আগ্রার অনুগত ছিলেন না। মোদ্দাকথা হচ্ছে, সচেতন বাঙালি বাংলাদেশ বা বেঙ্গলকে ভারতের অংশ হিসেবে ভাবতে চায়নি; কেননা সেটা তার আসল পরিচয় নয়। যেমন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জাতি রয়েছে– সিনহালিজ, নেপালি, ভুটানি, বর্মী, আফগান ইত্যাদি। অন্য কেউ কেউ স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট রয়েছে। যেমন শিখ, কাশ্মীরি, তামিল, অহোমীয়, মণিপুরি, বেলুচি, নাগা ইত্যাদি। আদিতে বৃহত্তর অখণ্ডিত ‘বাংলা’ও আমাদের কাম্য ছিল। তবে ভারতীয় কংগ্রেস দলের রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের জন্য তা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দী এবং জিন্নাহ জানিয়েছিলেন যে কংগ্রেস রাজি থাকলে অখণ্ড স্বাধীন বেঙ্গলে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু নেহরু এর তীব্র বিরোধিতা করেন। পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য ধারায়ই একটি মহা গণআন্দোলন এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে উপমহাদেশে তৃতীয় স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল স্বাধীন বাংলাদেশ। আর আমরা ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করি ২৬শে মার্চ। এই উদযাপনের মধ্য দিয়েই আমরা প্রকাশ করি বাঙালিদের জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি আমাদের আনুগত্য, সমর্থন এবং একাত্মতা। এ দিন আমাদের পরম গর্বের এবং আত্মোপলব্ধির।
এই দিবস উদযাপনের ভেতর দিয়ে আমরা জাতিগতভাবে আমাদের ঐক্যবোধ প্রকাশ করি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের ঔপনিবেশিক বেড়াজাল ছিন্ন করে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করল, তখন বিশ্বব্যাপীই প্রজ্বলিত হলো শান্তি ও প্রগতির আশার প্রদীপ। গড়ে উঠল জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক নানাবিধ উন্নয়নমূলক সংস্থা। দেশে দেশে হতে থাকল গণতন্ত্র, সাম্য ও সহযোগিতার আবাহন। স্লোগান উঠল– আর যুদ্ধ নয়, নয়– আর নয় মায়েদের শিশুদের কান্না– যুদ্ধ না, ধ্বংস না, মৃত্যু– আর না। স্বাধীনতার সূর্যালোকে আমরা দিবাস্বপ্ন দেখলাম এক সুন্দর, সুখী, শান্তিময় ধরিত্রীর। কিন্তু আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হলো না। আসলে সাম্রাজ্যবাদীরাই তাদের প্রস্থানের পূর্বে অশান্তি, বিবাদ ও স্বার্থ-সংঘাতের বীজ বপন করে গেল। এবং তা ক্রমে ক্রমে বেড়ে ওঠে বিস্তৃততর বিষবৃক্ষ হয়ে প্রায় সারা বিশ্বকেই গ্রাস করল।
ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্তে সৃষ্টি হলো তুমুল রক্তক্ষয়ী গণহত্যার লীলাভূমি প্যালেস্টাইনের বুকে ইসরায়েল– ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করে দিয়ে। হিটলারের স্মৃতি ম্লান হবার আগেই আবির্ভূত হলো তার চেয়েও ভয়ংকর নরখাদক ইসরায়েলি নেতা নেতানিয়াহু। কোরিয়া আর ভিয়েতনামে শুরু হলো দীর্ঘকালীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে তেলের নিয়ন্ত্রণ লোভে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রপ্রসূত বিধ্বংসী আগ্রাসন, দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে কাশ্মীরের জনগণের আত্মাধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-সংঘর্ষ, উপমহাদেশীয় দেশসমূহের সীমান্ত-সমস্যা, মিয়ানমারে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাংঘর্ষিক আন্দোলন ও রোহিঙ্গা গণহত্যা, বলকান-ইউক্রেন-এশিয়া-আফ্রিকার আরও বহু দেশে আগ্রাসন ও স্থানীয় যুদ্ধ। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বাবস্থার চেয়েও ভয়াবহ। তদুপরি আধিপত্যবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ও সামরিক শাসন এক বিভীষিকাময় নৈরাশ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার লুণ্ঠন এবং সবল শক্তিমানের যথেচ্ছচার মনে হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বিশ্বব্যাপী কখনও এভাবে এসেছে বলে মনে হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে, ‘এরই মাঝে পথ চিরে চিরে, নতুন সমুদ্রতীরে তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি, ডাকিছে কাণ্ডারী’। আমাদের সৌভাগ্য যে এই দুর্যোগে আমাদের কাণ্ডারী– বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা– তাঁর দক্ষতা ও বিচক্ষণতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় তরণীকে সঠিক পথেই পরিচালনা করছেন।
এটা অনস্বীকার্য যে আমরা আজ উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবমান। অর্জনের ফিরিস্তি আমি এখানে দিচ্ছি না। দৃশ্যমান যা, জনগণ তা জানেন। অবশ্য মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজারের লাগামছাড়া অবস্থা, ডলার সংকট ও দুর্নীতি বহু সমস্যা সৃষ্টি করেছে বৈকি, তবে এগুলো সামাল দেবার চেষ্টাও চলছে। আর সমস্যাহীন কোন দেশ-ই-বা আছে– এন্ডোরা, ভ্যাটিকান, মোনাকো এবংবিধ রাষ্ট্র কতিপয় ছাড়া। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবশ্য বাংলাদেশ যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। নেত্রীর নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি অভিষিক্ত হয়েছেন Mother of Humanity মানবতার জননী champion of the Earth ধরিত্রীর চ্যাম্পিয়ন– এ জাতীয় অতীব সম্মানজনক পদবিতে।
রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথ– সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক, কারও সঙ্গে বৈরিতা নেই– এই নীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি। তবে আমাদের সব সময় লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে আমাদের স্বার্থহানি যাতে কোনোক্রমে না হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে– আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরকালের বন্ধু বলে কেউ নেই; আবার চিরকালের বৈরীও কেউ থাকে না। প্রত্যেকের জাতীয় স্বার্থ তাদের নিজ নিজ অবস্থান নির্ণয় করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল জার্মানি, জাপান, ইতালি আর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহযোগী ছিল রাশিয়া ও চীন। বর্তমান সময়ে ঠিক উল্টো অবস্থা। সত্তরের দশকে আমাদের যে স্বার্থ ছিল, এখন তা নেই রয়েছে অন্যবিধ স্বার্থ। তখন ছিল মুক্তিযুদ্ধ বিজয়, স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি-প্রাপ্তি, বাণিজ্যিক ও শিল্পোন্নয়নে প্রারম্ভিক আনুকূল্য, চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ঔষধের সংস্থান, আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্নির্মাণ। আর আজ পাঁচ দশকাধিক কাল পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রধান স্বার্থ পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের স্বার্থ আজ সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার প্রাপ্তি, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান, শিল্পে বিনেয়োগ, সীমান্ত সুরক্ষা ও সীমান্ত হত্যার অবসান। নদীর নাব্যতা রক্ষণ, আন্তর্জাতিক নদীসমূহে পানি প্রবাহের ন্যায্য হিস্যা পাবার নিশ্চয়তা। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক টেকনোলজি প্রবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থার মোকাবিলা, স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন ইত্যাদি। এবং সহজ ভাষায় বলা যায়, আমাদের স্বার্থ রক্ষাই বর্তমানে আমাদের মিত্রকুল কে নির্ধারণ করবে।
অবশ্য তার জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত মনোযোগ এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে নিরীক্ষণ করতে হবে ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের সর্বদলীয় নীতি গ্রহণ করা সংগত হবে, যেমনটি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বর্তমান। আমরা সন্তুষ্টির সঙ্গে লক্ষ্য করেছি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষণা করেছে তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অধুনা প্রবর্তিত নাগরিকত্ব/ জাতীয়তা আইনের প্রয়োগ গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ করছে। বিজেপির নেতৃত্বে জারীকৃত এই নাগরিকত্ব নির্ধারণ আইনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের (বাংলাদেশসহ) শুধু মুসলমানদের ব্যাপারেই বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। আইনে এ জাতীয় ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার প্রবর্তন আমাদের বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সর্ব ধর্মাবলম্বীর প্রতি বৈষম্যহীন আচরণের নীতির প্রতি হুমকিস্বরূপ দেখা দিতে পারে। সে হিসেবে আইনটি ভারতে অভ্যন্তরীণ হলেও বাংলাদেশসহ অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের মুসলমানদের প্রতিও এটি প্রযোজ্য বিধায় আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি সংরক্ষণের স্বার্থ হানির সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কড়া নজর রাখতে হবে। তাছাড়া এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে (সিএএ), জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ (এনআরসি) প্রয়োগ করা হলে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে অনেক মুসলমান বাদ পড়বেন বলে হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের আসাম রাজ্যে এনআরসি কার্যকর করা হলে দেখা যায় এতে ১৯ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। এরা প্রায় সকলেই বাংলাভাষী মুসলিম। এই তালিকাতে বাদ পড়া নাগরিকদের মধ্যে কিছু সংখ্যক হিন্দু বাঙালিও রয়েছে। কিন্তু তারা সিএএর মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। তবে মুসলমানদের ঐ সুযোগ দেওয়া হবে না। বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক এই আইনের জন্য ফলাফলে দেখা যাবে অধিক সংখ্যক আসামের বাংলাভাষী মুসলমানকে নাগরিকত্বহীন করা হবে। তখন তারা কোথায় যাবে? আশঙ্কা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মতো তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা হবে। অথবা ধীরে ধীরে অনেককে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে। অথবা তারা বাংলাদেশে আত্মরক্ষায় নিজেরাই অনুপ্রবেশ করবেন। বাংলাদেশের জন্য এটা একটি বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করবে। ঐ সব নাগরিক ইতোমধ্যে মহা আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে আছেন। আদালতের দ্বারস্থ হয়েও সুবিচার পাচ্ছেন না বলে তারা দাবি করেছেন। এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ ও সাবধান হতে হবে। সরকারি পর্যায়ে এই সম্ভাব্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে এর সুরাহা করা বিশেষ প্রয়োজন। নইলে সৃষ্টি হতে পারে আরেক রোহিঙ্গা সমস্যা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রও ক্রমশই সমস্যাসংকুল হয়ে পড়ছে। আজ আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ উত্তর যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া কেন্দ্রিক Bi-polar world নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়ন (এবং ওয়ারসো প্যাক্ট) অবলুপ্তি-উত্তর unipolar (শুধু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র) world-ও আজ নেই। আমরা এখানে দেখছি এশিয়ার চ্যালেঞ্জ। ‘ন্যাম’ বা non-aligned movement আজ পুরোপুরি তাৎপর্যহীন বিশ্বমঞ্চে মহাশক্তিধর বা পরাশক্তি হিসেবে হয়েছে চীনের অভ্যুদয়। ‘বেল্ট ও রোড’ এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক বাণিজ্যিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা উন্নয়নকামী দেশগুলোর উন্নয়নেও ভুমিকা রাখছে। unipolar বিশ্ব থাকাকালীন অবদমিত রাশিয়া এই অসম্মানজনক অবস্থান স্বীকার করছে না স্বাভাবিকভাবেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ওয়ারসো প্যাক্ট অবলুপ্তির সময় ধারণা করা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী সামরিক জোট ন্যাটোর ক্রমাবসান হবে। কিন্তু হা হতোস্মি! আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ ন্যাটোকে আরও শক্তিশালী ও বিস্তৃততর করে তুলছে। পরিবর্তিত দুর্বল রাশিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি আরও জোরদার হচ্ছে। রাশিয়া এবং এর বর্তমান নেতা পুতিন এই অবস্থাকে আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তিবর্গের বিশ্বাসভঙ্গতা বলে জ্ঞান করছেন। এবং এতেই সৃষ্টি হয়েছে ইউক্রেন সমস্যা। আমেরিকা দিয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপর ‘স্যাংশন’। বাংলাদেশের ওপরেও এর প্রভাব পড়ছে। গাজার ওপর ইসরায়েলের শুরু করেছে এক বর্বরোচিত আক্রমণ। অনুষ্ঠিত করছে নির্লজ্জ গণহত্যা বা জেনোসাইড। আধুনিক বিশ্বে এ ধরনের নির্মম, নিষ্ঠুর পৈশাচিকতা অকল্পনীয় ছিল। নীতিগতভাবেই প্যালেস্টাইনের সমর্থনে রয়েছে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথেই। আমাদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে অতীব সচেতন থাকতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রয়েছে আমাদের ‘জিরো টলারেন্স’। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান, আন্তর্জাতিক নদীর বহমান পানির ন্যায্য অংশ প্রাপ্তি, হত্যামুক্ত সীমান্ত এবং রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার সংরক্ষণ পরিবর্ধন এবং দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের প্রায়োরিটি। খেয়াল রাখতে হবে যাতে গন্তব্য অভিমুখে আমাদের যাত্রা বিঘ্নিত না হয়।
এই প্রসঙ্গে প্রয়োজন রয়েছে বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের এক বিশেষ ভূমিকা। নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগজনিত শঙ্কার আর সীমান্ত হত্যার কথা আগেই বলেছি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বাস্তবায়ন সম্পাদন ও বাস্তবায়ন নিয়ে আর টালবাহানা নয়। এতে বাংলাদেশের এক বিরাট অঞ্চলের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদীর সুষম পানি বণ্টনের কথাও রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভারতকে আমাদের রপ্তানি পণ্যে গৃহীত ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ ব্যবস্থা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন। এবারকার আন্তর্জাতিক পানি দিবসের মূল প্রতিপাদ্যই ছিল water for peace– শান্তির জন্য পানি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পানি শান্তি কিংবা সংঘাত ঘটাতে পারে। পানির অসম বণ্টন বা দুষ্প্রাপ্যতা উত্তেজনা ও সংঘাত সৃষ্টি করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুষম পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনস্বার্থের সমৃদ্ধি, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহজতর হলে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে।’
আশা করি, স্বাধীনতা দিবসের সর্বজনীন উদযাপন জাতিকে উদ্বুদ্ধ করবে ঐক্যবদ্ধভাবে উন্নত ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশ স্থাপনের মহান লক্ষ্য অর্জনের পথে দৃপ্ত পদে এগিয়ে যেতে।
লেখক
সদস্য,
উপদেষ্টা পরিষদ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
- বিষয় :
- স্বাধীনতা দিবস